
বিতর্কিত পদোন্নতি পদ্ধতির বিরুদ্ধে ফের সরব হয়েছেন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের একাধিক বৈঠকের খবরে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। তাঁরা বলছেন, আদালতের রায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতির পক্ষে থাকলেও কর্তৃপক্ষ ভাইভা (মৌখিক পরীক্ষা) পদ্ধতি বহাল রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে, যা ষ্পষ্টতই আদালত অবমাননার শামিল।
তবে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষের তরফে মিলেছে ভিন্ন ব্যাখ্যা। বলা হচ্ছে, পদোন্নতির পদ্ধতির বিষয়ে আদালতের চূড়ান্ত রায় পাবার পরও তাদের রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন) করার সুযোগ রয়েছে। এই রিভিউ খারিজ হয়ে গেলেই আদালতের রায় অনুযায়ী দ্রুত পদোন্নতি দেয়া হবে।
ডিপিডিসি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতি বুধবার (১৮ জুন) সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর একটি চিঠি পাঠায়। এতে অভিযোগ করে বলা হয়, ডিপিডিসি একটি কমিটি গঠন করেছে যা পুরনো বিতর্কিত ইউনিফায়েড সার্ভিস রুলসের আলোকে গ্রেডেশন লিস্ট তৈরি করছে। অথচ হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট — দুই আদালতই জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতির পক্ষে রায় দিয়েছেন এবং ভাইভাভিত্তিক প্রক্রিয়াকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন।
ডিপিডিসির সার্ভিস রুলস ২০১৩-এর ২.৯ ধারা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেই পদোন্নতি হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৭ সালে তথাকথিত ‘ইউনিফায়েড সার্ভিস রুলস’ নামে একটি প্রহসনমূলক নীতিমালা চালু করে ভাইভাভিত্তিক পদোন্নতির পথ খুলে দেওয়া হয়। জানা যায়, স্বৈরাচার সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউস এই পদ্ধতি চালু করেছিলেন। আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও সেই বিতর্কিত পদ্ধতির মদদদাতারা আবারও সক্রিয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, বিতর্কিত এই পদ্ধতি পুনরায় চালু হলে প্রতিষ্ঠানটিতে বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাবে, যা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
প্রকৌশলী সমিতির মতে, এই পদ্ধতির মাধ্যমে অভিজ্ঞ, মেধাবী ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের ভাইভা নামক মুখোশে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে, অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ছে।
জানা যায়, ২০১৭ সালে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও বিদ্যুৎ সচিব আহমেদ কায়কাউসের নির্দেশনায় 'ইউনিফাইড সার্ভিস রুল ২০১৭' প্রণয়ন করা হয়। ডিপিডিসির সার্ভিস রুল ২০১৩-এর ২.৯ ধারা মোতাবেক পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার কথা বলা ছিল। কিন্তু ইউনিফাইড সার্ভিস রুল ২০১৭-তে তা বাদ দেয়া হয়। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিনের কর্মরত অভিজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাদ দিয়ে পাঁচ মিনিটের ভাইভা পদ্ধতির মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, কোটি টাকার ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে জুনিয়র, অনভিজ্ঞ ও দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতেই বৈষম্যমূলক এই সার্ভিস রুলটি করা হয়।
বিষয়টি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বিদ্যুৎ বিতরণী সংস্থাটিতে। এর ধারাবাহিকতায় ডিপিডিসির কর্মকর্তাদের একাংশ ২০১৯ সালে হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। ২০২১ সালে মামলার রায়ে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়ার কথা বলা হয়। ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ মামলার রায় বাস্তবায়ন না করে আপিল করে এবং মামলাটি বিভিন্নভাবে দীর্ঘায়িত করে। কিন্তু গত ২০ মে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়টি বহাল রাখেন।
কিন্তু এ রায় কার্যকরের পরিবর্তে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ সেই পুরনো কমিটিকেই আরও সক্রিয় করেছে। এতে করে আদালতের রায় কার্যকর না করার একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্তের ইঙ্গিত মিলছে।
প্রকৌশলী সমিতির সভাপতি এ কে এম বদরুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন হাওলাদার এক বিবৃতিতে বলেন, “আদালতের রায় লঙ্ঘন করে আবারো ভাইভা পদ্ধতি চালু রাখার প্রয়াস মানে আদালতের প্রতি চরম অবমাননা ও প্রতিষ্ঠানের ভিত ধ্বংস করা।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একাধিক প্রকৌশলী জানান, প্রশাসন এতোদিন বলে আসছিলো মামলার কারণে পদোন্নতি আটকে আছে, কিন্তু সিনিয়রিটির ভিত্তিতে পদোন্নতির হাইকোর্টের রায়ের বিপক্ষে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ আপিল করলেও পূর্বের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। তাই প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে সকল পদে এখনই সিনিয়রিটির ভিত্তিতে পদোন্নতি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তির কার্যকলাপ প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আরো হতাশা বৃদ্ধি করছে। প্রশাসনের ওই ব্যক্তিরা বিতর্কিত ভাইবা পদ্ধতি বহাল রাখার মাধ্যমে পদোন্নতি বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ আবারও রাখতে চাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ আদালতের রায় পুনঃপুন লঙ্ঘন কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাকেই নষ্ট করে না, এটি গোটা সরকারি সেবার প্রতি নাগরিক আস্থাকে দুর্বল করে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, “যখন সুপ্রিম কোর্টের রায় বাস্তবায়ন হয় না, তখন তা প্রশাসনিক ঔদ্ধত্যেরই প্রতিচ্ছবি। এটি আদালতের অবমাননা ও গণতন্ত্রের মূলে আঘাত।”
ডিপিডিসির প্রকৌশলীরা বলেন, অফিস আদেশ জারির মাধ্যমে আবারও ভাইভা পদ্ধতিতে পদোন্নতির আয়োজন শুরু হয়েছে। এতে করে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। কর্মস্থলে বিক্ষোভ ও কর্মবিরতির মতো কর্মসূচির কথাও উঠছে।
সূত্র জানায়, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিদ্যুৎ ভবনে একাধিকবার গোপন বৈঠকে ডিপিডিসির কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা আলোচনায় বসেন। কীভাবে পুরনো পদ্ধতি বহাল রাখা যায়, মূলত তা নিয়েই বৈঠকটি হয়। এতে ডিপিডিসির প্রশাসন বিভাগের এক নির্বাহী পরিচালকের মদদ রয়েছে বলে সূত্রের দাবি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অ্যাডমিন ও এইচআর) সোনামণি চাকমার মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি তা কেটে দেন।
উল্লেখ্য, ডিপিডিসির বেশ কয়েকটি প্রকল্পে জনবল সংকটের মধ্যেই অতিরিক্ত পদায়ন হয়েছে, অথচ নিয়মিত পদোন্নতি না হওয়ায় পদ ফাঁকা থেকে যাচ্ছে। জনবল সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সেবা ব্যাহত হচ্ছে, বাড়ছে গ্রাহকদের দুর্ভোগ। এই প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী “এন্ট্রি লেভেল ফিডার পদ” ভিত্তিক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছে প্রকৌশলী সমাজ। বিশ্লেষকদের মতে, আদালতের রায় অমান্য করে ডিপিডিসি যে পথে হাঁটছে, তা শুধু আইনভঙ্গই নয়, জনস্বার্থবিরোধীও বটে। এই অবস্থা চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠানটি মুখ থুবড়ে পড়বে।
জানা গেছে, জনবল সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং জরুরি সেবাগুলো সময়মতো দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি বেশিরভাগ কর্মকর্তাকে তাঁদের দায়িত্বের অতিরিক্ত কাজ করতে হচ্ছে পারিশ্রমিক ছাড়াই। বাড়তি পরিশ্রম যেমন এসব কর্মকর্তার শারীরিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে, তেমনি এক ধরনের মানসিক চাপ ও হতাশার মুখোমুখি হচ্ছেন তাঁরা। অনেক প্রকৌশলী পদোন্নতি না পেয়ে উন্নত চাকরির জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেককে মনে কষ্ট নিয়ে অবসরে চলে যেতে হচ্ছে। এতে সেবামূলক এই খাতটিতে বিরুপ প্রভাব পড়ছে। সেই সঙ্গে গ্রাহকসেবায় বাড়ছে দুর্ভোগ।
বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) ও ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নূর আহমদ বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বাংলা স্কুপকে বলেন, আদালতের নির্দেশ মোতাবেক আমরা কাজ করতে বাধ্য। আমি ইতিমধ্যে ডিপিডিসির আইন বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। যেহেতু আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন) করার বিধান রয়েছে, আমরা তা করব। আদালতের নির্দেশনার বাইরে কিছুই করা হবে না।
পদোন্নতি নিয়ে প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি পদোন্নতির পক্ষে। যে কোনো প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সময়মত পদোন্নতি দিলে তাঁদের কাজের দক্ষতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা বৃদ্ধি পায়। আর তখনই তাঁদের কাছ থেকে শতভাগ পেশিদারিত্ব পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
বাংলাস্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন/এসকে
অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানালেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
আদালতের রায় মানছে না ডিপিডিসি!
পদ ফাঁকা, তবু নেই পদোন্নতি!
মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চিতে বিশেষজ্ঞ কমিটি
তবে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষের তরফে মিলেছে ভিন্ন ব্যাখ্যা। বলা হচ্ছে, পদোন্নতির পদ্ধতির বিষয়ে আদালতের চূড়ান্ত রায় পাবার পরও তাদের রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন) করার সুযোগ রয়েছে। এই রিভিউ খারিজ হয়ে গেলেই আদালতের রায় অনুযায়ী দ্রুত পদোন্নতি দেয়া হবে।
ডিপিডিসি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতি বুধবার (১৮ জুন) সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর একটি চিঠি পাঠায়। এতে অভিযোগ করে বলা হয়, ডিপিডিসি একটি কমিটি গঠন করেছে যা পুরনো বিতর্কিত ইউনিফায়েড সার্ভিস রুলসের আলোকে গ্রেডেশন লিস্ট তৈরি করছে। অথচ হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট — দুই আদালতই জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতির পক্ষে রায় দিয়েছেন এবং ভাইভাভিত্তিক প্রক্রিয়াকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন।
ডিপিডিসির সার্ভিস রুলস ২০১৩-এর ২.৯ ধারা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেই পদোন্নতি হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৭ সালে তথাকথিত ‘ইউনিফায়েড সার্ভিস রুলস’ নামে একটি প্রহসনমূলক নীতিমালা চালু করে ভাইভাভিত্তিক পদোন্নতির পথ খুলে দেওয়া হয়। জানা যায়, স্বৈরাচার সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউস এই পদ্ধতি চালু করেছিলেন। আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও সেই বিতর্কিত পদ্ধতির মদদদাতারা আবারও সক্রিয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, বিতর্কিত এই পদ্ধতি পুনরায় চালু হলে প্রতিষ্ঠানটিতে বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাবে, যা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
প্রকৌশলী সমিতির মতে, এই পদ্ধতির মাধ্যমে অভিজ্ঞ, মেধাবী ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের ভাইভা নামক মুখোশে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে, অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ছে।
জানা যায়, ২০১৭ সালে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও বিদ্যুৎ সচিব আহমেদ কায়কাউসের নির্দেশনায় 'ইউনিফাইড সার্ভিস রুল ২০১৭' প্রণয়ন করা হয়। ডিপিডিসির সার্ভিস রুল ২০১৩-এর ২.৯ ধারা মোতাবেক পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার কথা বলা ছিল। কিন্তু ইউনিফাইড সার্ভিস রুল ২০১৭-তে তা বাদ দেয়া হয়। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিনের কর্মরত অভিজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাদ দিয়ে পাঁচ মিনিটের ভাইভা পদ্ধতির মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, কোটি টাকার ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে জুনিয়র, অনভিজ্ঞ ও দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতেই বৈষম্যমূলক এই সার্ভিস রুলটি করা হয়।
বিষয়টি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বিদ্যুৎ বিতরণী সংস্থাটিতে। এর ধারাবাহিকতায় ডিপিডিসির কর্মকর্তাদের একাংশ ২০১৯ সালে হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। ২০২১ সালে মামলার রায়ে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়ার কথা বলা হয়। ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ মামলার রায় বাস্তবায়ন না করে আপিল করে এবং মামলাটি বিভিন্নভাবে দীর্ঘায়িত করে। কিন্তু গত ২০ মে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়টি বহাল রাখেন।
কিন্তু এ রায় কার্যকরের পরিবর্তে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ সেই পুরনো কমিটিকেই আরও সক্রিয় করেছে। এতে করে আদালতের রায় কার্যকর না করার একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্তের ইঙ্গিত মিলছে।
প্রকৌশলী সমিতির সভাপতি এ কে এম বদরুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন হাওলাদার এক বিবৃতিতে বলেন, “আদালতের রায় লঙ্ঘন করে আবারো ভাইভা পদ্ধতি চালু রাখার প্রয়াস মানে আদালতের প্রতি চরম অবমাননা ও প্রতিষ্ঠানের ভিত ধ্বংস করা।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একাধিক প্রকৌশলী জানান, প্রশাসন এতোদিন বলে আসছিলো মামলার কারণে পদোন্নতি আটকে আছে, কিন্তু সিনিয়রিটির ভিত্তিতে পদোন্নতির হাইকোর্টের রায়ের বিপক্ষে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ আপিল করলেও পূর্বের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। তাই প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে সকল পদে এখনই সিনিয়রিটির ভিত্তিতে পদোন্নতি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তির কার্যকলাপ প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আরো হতাশা বৃদ্ধি করছে। প্রশাসনের ওই ব্যক্তিরা বিতর্কিত ভাইবা পদ্ধতি বহাল রাখার মাধ্যমে পদোন্নতি বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ আবারও রাখতে চাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ আদালতের রায় পুনঃপুন লঙ্ঘন কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাকেই নষ্ট করে না, এটি গোটা সরকারি সেবার প্রতি নাগরিক আস্থাকে দুর্বল করে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, “যখন সুপ্রিম কোর্টের রায় বাস্তবায়ন হয় না, তখন তা প্রশাসনিক ঔদ্ধত্যেরই প্রতিচ্ছবি। এটি আদালতের অবমাননা ও গণতন্ত্রের মূলে আঘাত।”
ডিপিডিসির প্রকৌশলীরা বলেন, অফিস আদেশ জারির মাধ্যমে আবারও ভাইভা পদ্ধতিতে পদোন্নতির আয়োজন শুরু হয়েছে। এতে করে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। কর্মস্থলে বিক্ষোভ ও কর্মবিরতির মতো কর্মসূচির কথাও উঠছে।
সূত্র জানায়, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিদ্যুৎ ভবনে একাধিকবার গোপন বৈঠকে ডিপিডিসির কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা আলোচনায় বসেন। কীভাবে পুরনো পদ্ধতি বহাল রাখা যায়, মূলত তা নিয়েই বৈঠকটি হয়। এতে ডিপিডিসির প্রশাসন বিভাগের এক নির্বাহী পরিচালকের মদদ রয়েছে বলে সূত্রের দাবি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অ্যাডমিন ও এইচআর) সোনামণি চাকমার মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি তা কেটে দেন।
উল্লেখ্য, ডিপিডিসির বেশ কয়েকটি প্রকল্পে জনবল সংকটের মধ্যেই অতিরিক্ত পদায়ন হয়েছে, অথচ নিয়মিত পদোন্নতি না হওয়ায় পদ ফাঁকা থেকে যাচ্ছে। জনবল সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সেবা ব্যাহত হচ্ছে, বাড়ছে গ্রাহকদের দুর্ভোগ। এই প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী “এন্ট্রি লেভেল ফিডার পদ” ভিত্তিক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছে প্রকৌশলী সমাজ। বিশ্লেষকদের মতে, আদালতের রায় অমান্য করে ডিপিডিসি যে পথে হাঁটছে, তা শুধু আইনভঙ্গই নয়, জনস্বার্থবিরোধীও বটে। এই অবস্থা চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠানটি মুখ থুবড়ে পড়বে।
জানা গেছে, জনবল সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং জরুরি সেবাগুলো সময়মতো দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি বেশিরভাগ কর্মকর্তাকে তাঁদের দায়িত্বের অতিরিক্ত কাজ করতে হচ্ছে পারিশ্রমিক ছাড়াই। বাড়তি পরিশ্রম যেমন এসব কর্মকর্তার শারীরিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে, তেমনি এক ধরনের মানসিক চাপ ও হতাশার মুখোমুখি হচ্ছেন তাঁরা। অনেক প্রকৌশলী পদোন্নতি না পেয়ে উন্নত চাকরির জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেককে মনে কষ্ট নিয়ে অবসরে চলে যেতে হচ্ছে। এতে সেবামূলক এই খাতটিতে বিরুপ প্রভাব পড়ছে। সেই সঙ্গে গ্রাহকসেবায় বাড়ছে দুর্ভোগ।
বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) ও ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নূর আহমদ বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বাংলা স্কুপকে বলেন, আদালতের নির্দেশ মোতাবেক আমরা কাজ করতে বাধ্য। আমি ইতিমধ্যে ডিপিডিসির আইন বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। যেহেতু আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন) করার বিধান রয়েছে, আমরা তা করব। আদালতের নির্দেশনার বাইরে কিছুই করা হবে না।
পদোন্নতি নিয়ে প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি পদোন্নতির পক্ষে। যে কোনো প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সময়মত পদোন্নতি দিলে তাঁদের কাজের দক্ষতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা বৃদ্ধি পায়। আর তখনই তাঁদের কাছ থেকে শতভাগ পেশিদারিত্ব পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
বাংলাস্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন/এসকে
অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানালেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
আদালতের রায় মানছে না ডিপিডিসি!
পদ ফাঁকা, তবু নেই পদোন্নতি!
মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চিতে বিশেষজ্ঞ কমিটি