আদালতের রায়ে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়ার কথা থাকলেও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) কর্তৃপক্ষ তা মানছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, স্বৈরাচার সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউসের করা ভাইভা (মৌখিক পরীক্ষা) পদ্ধতি বহাল রাখার চক্রান্ত চলছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাবে, যা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এ নিয়ে ডিপিডিসিতে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হচ্ছে, আদালতের রায়ের সার্টিফায়েড কপি এখনও হাতে আসেনি। এদিকে, বিষয়টির সুস্পষ্ট সুরাহা না হলেও কর্মচারীদের পদোন্নতি দিতে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের একটি আফিস আদেশ জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। যা আরো জটিলতার সৃষ্টি করবে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, ২০১৭ সালে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও বিদ্যুৎ সচিব আহমেদ কায়কাউসের নির্দেশনায় 'ইউনিফাইড সার্ভিস রুল ২০১৭' প্রণয়ন করা হয়। ডিপিডিসির সার্ভিস রুল ২০১৩-এর ২.৯ ধারা মোতাবেক পদোন্নীতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার কথা বলা ছিল। কিন্তু ইউনিফাইড সার্ভিস রুল ২০১৭-তে তা বাদ দেয়া হয়। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিনের কর্মরত অভিজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাদ দিয়ে পাঁচ মিনিটের ভাইভা পদ্ধতির মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, কোটি টাকার ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে জুনিয়র, অনভিজ্ঞ ও দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতেই বৈষম্যমূলক এই সার্ভিস রুলটি করা হয়।
বিষয়টি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বিদ্যুৎ বিতরণী সংস্থাটিতে। এর ধারাবাহিকতায় ডিপিডিসির কর্মকর্তাদের একাংশ ২০১৯ সালে হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। ২০২১ সালে মামলার রায়ে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়ার কথা বলা হয়। ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ মামলার রায় বাস্তবায়ন না করে আপিল করেন এবং মামলাটি বিভিন্নভাবে দীর্ঘায়িত করেন। কিন্তু মঙ্গলবার (২০ মে) আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়টি বহাল রাখেন।
আপিলের বিভাগের সর্বশেষ অবস্থান জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতি প্রদানের পক্ষে হলেও তা যেন মানতে নারাজ ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার আপিল বিভাগের আদেশের দিনই কর্মচারীদের পদোন্নতি দিতে ভাইবা নেওয়ার একটি আফিস আদেশ জারি করা হয়। এতে প্রতিষ্ঠানটির পদোন্নতি সংক্রন্ত বিষয়ে আরো বেশি জটিলতার তৈরি করবে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
বিতর্কিত ভাইভা পদ্ধতি বহাল রাখার এই চক্রান্ত পতিত সরকারের মদদপুষ্ট ব্যক্তিদের, এমন অভিযোগ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তাঁরা বলছেন, মৌখিক পরীক্ষার এই পদ্ধতি কার্যত মেধা যাচাইয়ের মুখোশে পদোন্নতি বাণিজ্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। ডিপিডিসিতে পদোন্নতি বাণিজ্যের ফলে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। সিনিয়র যোগ্য কর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছেন, আর অযোগ্যরা পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, চারজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে তাদের থেকে দক্ষ, মেধাবী ও সিনিয়র ১২ জন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে ডিঙ্গিয়ে প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি নেন। প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তিনজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, দুইজন নির্বাহী প্রকৌশলী এবং ১৫ জন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি নেন। কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের বৈষম্য একটি নেতিবাচক সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যা কর্মীদের কর্মক্ষমতা ও মনোবলের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। সেই সাথে প্রতিষ্ঠানের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে যাচ্ছে।
ডিপিডিসি সূত্র জানায়, সার্ভিস রুলস সংশোধন এবং পরিমার্জনের জন্য ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ উপদেষ্টা এবং বিদ্যুৎ বিভাগের অফিস আদেশে বৈষম্য নিরসনে নিয়োগ ও পদোন্নতি বিষয়ে হালনাগাদ/সংশোধন নীতিমালা প্রেরণ করতে বলা হয়। কিন্তু ডিপিডিসি এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা তার সুস্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
এরপর গত ২৯ এপ্রিল কর্মকর্তা/কমচারীদের মধ্যে পদভিত্তিক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ এবং গ্রেডেশন লিস্ট প্রণয়নের জন্য ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির কাজ চলমান থাকা অবস্থায়ই আপিল বিভাগের রায়টি এলো।
ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে যারা বিদ্যুৎ খাত ধ্বংসের কারিগর ছিল তারাই বৈষম্যযুক্ত ইউনিফাইড সার্ভিস রুল ২০১৭ বাস্তবায়ন করতে চায়। এদের সহায়তাকারীদের অন্যতম ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অ্যাডমিন ও এইচআর) সোনামণি চাকমা, জিএম (এইচআর) মো. হাসনাত চৌধুরী, ডিজিএম (এইচআর) মো. মনিরুজ্জামান এবং ডিজিএম (লিগাল অ্যান্ড এফেয়ার্স) নিহাররঞ্জন সরকার। হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করলেও ভাইবা পদ্ধতির মাধ্যমে পদোন্নতি দেয়ার চেষ্টা চলছে এদের মদদেই। তারা যে কোন মূল্যে বিতর্কিত পদ্ধতিটি বহাল রাখতে চায়, যেখানে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে পদোন্নতি প্রদান করা হবে।
জানা গেছে, মঙ্গলবার (২০ মে) বিকেলে ডিজিএম মো. মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত একটি অফিস আদেশের মাধ্যমে ডাটা এন্ট্রি কো-অর্ডিনেটর, সুইচ বোর্ড অ্যাটেনডেন্ট, বিল সুপারভাইজার, কমপ্লেইন সুপারভাইজার, ড্রাফটসম্যান, ফোরম্যান, অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্টেন্ট পদে কর্মরতদের পদোন্নতি দিতে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়েছে। আগামী ২৫ থেকে ২৭ মে পর্যন্ত বিদ্যুৎভবনে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
এই অফিস আদেশ জারির পর ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে ডিপিডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁরা বলেন, ভাইভা পরীক্ষার নামমাত্র ফলাফল এবং স্কোরিং সিস্টেম কোনো নির্ধারিত মানদণ্ড মেনে চলে না। ইতোপূর্বে পদোন্নতির জন্য বিপুল অংকের অর্থ লেনদেন হয়েছে। যেসব কর্মী এই ‘বাণিজ্যে’ অংশ নেননি, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে উল্লেখ করে দ্রুত জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতি প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করার দাবি জানিয়েছেন প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এদিকে, ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অ্যাডমিন ও এইচআর) সোনামণি চাকমা বলেন, আদালতের আদেশের বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে আদেশের সার্টিফায়েড কপি হাতে পাইনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদোন্নতির জন্য মৌখিক পরীক্ষার তারিখ তড়িঘড়ি করে দেওয়া হয়নি। এটি আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। সেই অনুযায়ী মঙ্গলবার (২০ মে) অফিস আদেশ জারি করা হয়। আদালতের আদেশ অনুযায়ী, পদোন্নতির প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে আমরা বদ্ধপরিকর।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ বুধবার (২১ মে) বিকেলে বাংলা স্কুপকে বলেন, গতকাল আদালত কী আদেশ দিয়েছেন, তা আমি অবগত নই। আপনার কাছ থেকেই বিষয়টি জানলাম। ডিপিডিসি বোর্ড চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপিল বিভাগের আদেশের পরই তড়িঘড়ি করে কেন মৌখিক পরীক্ষা ডাকা হলো, তা আমি খতিয়ে দেখব।
বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন/এইচএ/এসকে
মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চিতে বিশেষজ্ঞ কমিটি