বাংলা স্কুপ স্পেশাল:
পাট থেকে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের টেকসই পদ্ধতি বিস্তৃতির জন্য পৃথক কারখানা স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। পাটের বহুমুখী ব্যবহারের ক্ষেত্র প্রসারে এই কারখানায় পাট থেকে পরিবেশবান্ধব পচনশীল যৌগিক পলিমার তৈরি করে সোনালি ব্যাগসহ বিভিন্ন মোড়ক সামগ্রী তৈরি করা হবে। পরিবেশবান্ধব পচনশীল মোড়ক সামগ্রী উৎপাদন ও রপ্তানির মাধ্যমে অর্জন করা হবে বৈদেশিক মুদ্রা। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে বাণিজ্যিকভাবে চালু হবে পাটের ব্যাগ তৈরির কাজ। এক কেজিতে গড়ে ১০০ ব্যাগ করা যায়। প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৫ টন সোনালি ব্যাগ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ঝুলে থাকা পরিবেশবান্ধব এই প্রকল্পটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নতুন করে গুরুত্ব পাচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের পর পরিবেশগতভাবে টেকসই উদ্যোগের অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে পরিকল্পনা কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশন এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট থেকে পরিবেশবান্ধব ও পচনশীল 'সোনালী ব্যাগ' উদ্ভাবন হয় ২০১৬ সালে। ২০১৭ সাল পরীক্ষামূলকভাবে বাজারজাত করা হয় শপিং ব্যাগটি। কিন্তু এর পর বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) উদ্যোগের আওতায় সোনালী ব্যাগ উৎপাদনে কারখানা স্থাপনের প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতেই কেটে যায় ছয় বছর। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে। তারপর আবার দেড় বছর পরিকল্পনা কমিশনে আটকে থাকে প্রস্তাবটি। অবশেষে ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির পর্যালোচনার পর প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোবারক আহমদ খান গত ২৮ আগস্ট সচিবালয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সোনালি ব্যাগের নমুনা হস্তান্তর করেন। ওই বৈঠকের পরই নড়েচড়ে বসে বিজেএমসি। তারা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ‘পাট হতে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের টেকসই পদ্ধতি বিস্তৃতীকরণের লক্ষ্যে পাইলট কারখানা স্থাপন’ প্রকল্পের একটি প্রস্তাব পাঠায়। গত বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ওই প্রকল্পের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ১০০ কোটি টাকা। ব্যাগ তৈরির শুরু থেকে তিন বছরেই এই টাকা ব্যয় করা হবে।
বিজেএমসি তাদের প্রস্তাবিত প্রকল্পে ডেমরায় লতিফ বাওয়ানি জুট মিলসের জায়গায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সোনালী ব্যাগ উৎপাদনের জন্য পাইলট কারখানার প্রস্তাব করেছে। এ প্রকল্পে সীমিত আকার বাণিজ্যিক উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত কারখানায় বছরে ১ হাজার ৫০০ টন সোনালি ব্যাগ ও পলিথিনের বিকল্প মোড়ক সামগ্রী উৎপাদিত হবে। প্রতিদিন গড়ে উৎপাদন হবে ৫ টন পলিমার ব্যাগ।
সোনালি ব্যাগের আবিষ্কারক মোবারক আহমদ খান। তিনি বর্তমানে বিজেএমসির প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, বিগত সরকারের উদ্যোগের ঘাটতি ছিল বলে আবিষ্কারের পর প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে লম্বা সময় লেগেছে। এখন অনুমোদন প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবিত কারখানাটি হবে কি না, তা নিয়েও অশ্চিয়তা রয়েছে, বলেন তিনি। মোবারক আহমদ খান আরও বলেন, এ প্রকল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন দেশ সোনালি ব্যাগে আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রয়োজনে বেসরকারিভাবেও এ ব্যাগ উৎপাদন সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে সরকারের নীতি সহায়তার প্রয়োজন হবে।
বিজেএমসির মুখ্য পরিচালন কর্মকর্তা মো. নাসিমুল ইসলাম বলেন, ২০২৫ সাল থেকেই আমরা বাণিজ্যিকভাবে সোনালি ব্যাগ তৈরি করতে পারবো। সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের পাইলট প্রকল্পও শেষ হয়েছে। ১০০ কোটি টাকার একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এর আওতায় বাণিজ্যিকভাবে শুরু হবে সোনালি ব্যাগ তৈরির কাজ।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পাট দিয়ে তৈরি সোনালি ব্যাগ দেশের পাটের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে অবদান রাখবে। সোনালি ব্যাগ পরিবেশবান্ধব। এ ব্যাগের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সোনালি ব্যাগ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিশ্বের প্যাকেজিংয়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে। এ ব্যাগ বহুল ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পাট মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সোনালি ব্যাগ দেখতে প্রচলিত পলিথিনের মতোই। এটি হালকা-পাতলা ও টেকসই। পাটের সূক্ষ্ম সেলুলোজ প্রক্রিয়াজাত করে এ ব্যাগ তৈরি করা হয়। পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ মাটিতে ফেললে তা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশ দূষিত হবে না। একটি ব্যাগ একাধিকবার ব্যবহার করা যায়।
সূত্র আরও জানায়, সোনালি আঁশখ্যাত পাট বাঙালির এক অনন্য গর্বের বিষয়। উন্নত প্রযুক্তি, গবেষণা ও শিল্পের মধ্য দিয়ে পাটের বহুমুখী ব্যবহার এবং অধিকতর মূল্য সংযোজনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফসল পাটের নির্যাস থেকে পলিথিনের বিকল্প পদার্থ তৈরি। এই গবেষণার ফসলকে শিল্পায়ন করে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিজেএমসি ২০১৭ সালে একটি গবেষণাভিত্তিক প্রাথমিক প্রকল্প গ্রহণ করে এবং পলিথিনের বিকল্প পাট থেকে পরিবেশবান্ধব ও পচনশীল ‘সোনালি ব্যাগ’ প্রস্তুত করে সীমিত আকারে বাজারজাত করতে সক্ষম হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ৫২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার অন্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি, ১৯ কোটি টাকার রাসায়নিক পদার্থ, সাড়ে ১৩ কোটি টাকার কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ কেনা হবে। এছাড়া গবেষণাগার সরঞ্জামাদি, ভবন ও স্থাপনা, পরামর্শকের সম্মানী, শ্রমিক ও আউটসোর্সিং খাতে ব্যয় করা হবে। প্রকল্পের মাধ্যমে পাট পলিমার থেকে উৎপাদিত শপিং ব্যাগসহ নিত্যপণ্যের মোড়কে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে সোনালি ব্যাগের বহুমুখী ব্যবহারসহ এ শিল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা সম্ভব হবে। কৃষকরা পাট উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন। দেশের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে এবং বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হবে। ফলে দারিদ্র্য বিমোচনসহ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। প্রকল্পের আওতায় ৫২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি, ১৯ কোটি টাকার রাসায়নিক পদার্থ, সাড়ে ১৩ কোটি টাকার কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ কেনা হবে। এছাড়া গবেষণাগার সরঞ্জামাদি, ভবন ও স্থাপনা, পরামর্শকের সম্মানী, শ্রমিক ও আউটসোর্সিং খাতে ব্যয় করা হবে।
বর্তমানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ব্যাগের ৪০ শতাংশই একবার ব্যবহৃত হয়। প্লাস্টিকের তৈরি ব্যাগ অপচনশীল হওয়ায় তা পরিবেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। এই প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে বেড়ে যায়, যা পরিবেশের অন্যতম ক্ষতির কারণ। প্লাস্টিকের ব্যাগ শুধু পরিবেশ নয়, মানবদেহের জন্যও ক্ষতিকর। ইতোমধ্যে মানবদেহে মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বিজেএমসি জানায়, ২০০২ সালে আমাদের দেশে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এর পরিবেশবান্ধব কোনো বিকল্প না থাকায় কার্যকরভাবে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ঢাকা শহরে বিভিন্নভাবে ক্রমাগত প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পরিবেশ দূষিত হওয়াসহ মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস, বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি ও নতুন রোগের সৃষ্টি, পলিথিন জমে জলাবদ্ধতা ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশের দূষণ কমাতে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের সেলুলোজ থেকে তৈরি এ সোনালি ব্যাগ ব্যবহৃত হতে পারে। ব্যাগটি বাহ্যিকভাবে পলিব্যাগের মতো দেখালেও এটি মাটিতে সম্পূর্ণ পচনশীল এবং পানিতে দ্রবণীয়। এটি খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের কাজেও ব্যবহার করা যায়। আগুনে পুড়লে ছাই হয়ে যায় কিন্তু বিষাক্ত কোনো গ্যাস তৈরি করে না। সোনালি ব্যাগের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া, এটি প্রয়োজনে রিসাইক্লিং করে দুই থেকে তিনবার ব্যবহার করাও সম্ভব। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে এককভাবে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের পাটের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত এবং সফল পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হলে, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একইভাবে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী ও উদ্বুদ্ধ হবেন। প্রকল্পটি লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব হবে বিধায় ছোট ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন এবং প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। পাটচাষিরা পাটের ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং অধিকহারে পাট উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন। ফলে সার্বিকভাবে কৃষক পর্যায়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বিভিন্নভাবে কার্যকরী অবদান রাখবে।
প্রতিবেদক/এএইচ/এসকে
পাট থেকে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের টেকসই পদ্ধতি বিস্তৃতির জন্য পৃথক কারখানা স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। পাটের বহুমুখী ব্যবহারের ক্ষেত্র প্রসারে এই কারখানায় পাট থেকে পরিবেশবান্ধব পচনশীল যৌগিক পলিমার তৈরি করে সোনালি ব্যাগসহ বিভিন্ন মোড়ক সামগ্রী তৈরি করা হবে। পরিবেশবান্ধব পচনশীল মোড়ক সামগ্রী উৎপাদন ও রপ্তানির মাধ্যমে অর্জন করা হবে বৈদেশিক মুদ্রা। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে বাণিজ্যিকভাবে চালু হবে পাটের ব্যাগ তৈরির কাজ। এক কেজিতে গড়ে ১০০ ব্যাগ করা যায়। প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৫ টন সোনালি ব্যাগ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ঝুলে থাকা পরিবেশবান্ধব এই প্রকল্পটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নতুন করে গুরুত্ব পাচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের পর পরিবেশগতভাবে টেকসই উদ্যোগের অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে পরিকল্পনা কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশন এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট থেকে পরিবেশবান্ধব ও পচনশীল 'সোনালী ব্যাগ' উদ্ভাবন হয় ২০১৬ সালে। ২০১৭ সাল পরীক্ষামূলকভাবে বাজারজাত করা হয় শপিং ব্যাগটি। কিন্তু এর পর বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) উদ্যোগের আওতায় সোনালী ব্যাগ উৎপাদনে কারখানা স্থাপনের প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতেই কেটে যায় ছয় বছর। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে। তারপর আবার দেড় বছর পরিকল্পনা কমিশনে আটকে থাকে প্রস্তাবটি। অবশেষে ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির পর্যালোচনার পর প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোবারক আহমদ খান গত ২৮ আগস্ট সচিবালয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সোনালি ব্যাগের নমুনা হস্তান্তর করেন। ওই বৈঠকের পরই নড়েচড়ে বসে বিজেএমসি। তারা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ‘পাট হতে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের টেকসই পদ্ধতি বিস্তৃতীকরণের লক্ষ্যে পাইলট কারখানা স্থাপন’ প্রকল্পের একটি প্রস্তাব পাঠায়। গত বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ওই প্রকল্পের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ১০০ কোটি টাকা। ব্যাগ তৈরির শুরু থেকে তিন বছরেই এই টাকা ব্যয় করা হবে।
বিজেএমসি তাদের প্রস্তাবিত প্রকল্পে ডেমরায় লতিফ বাওয়ানি জুট মিলসের জায়গায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সোনালী ব্যাগ উৎপাদনের জন্য পাইলট কারখানার প্রস্তাব করেছে। এ প্রকল্পে সীমিত আকার বাণিজ্যিক উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত কারখানায় বছরে ১ হাজার ৫০০ টন সোনালি ব্যাগ ও পলিথিনের বিকল্প মোড়ক সামগ্রী উৎপাদিত হবে। প্রতিদিন গড়ে উৎপাদন হবে ৫ টন পলিমার ব্যাগ।
সোনালি ব্যাগের আবিষ্কারক মোবারক আহমদ খান। তিনি বর্তমানে বিজেএমসির প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, বিগত সরকারের উদ্যোগের ঘাটতি ছিল বলে আবিষ্কারের পর প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে লম্বা সময় লেগেছে। এখন অনুমোদন প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবিত কারখানাটি হবে কি না, তা নিয়েও অশ্চিয়তা রয়েছে, বলেন তিনি। মোবারক আহমদ খান আরও বলেন, এ প্রকল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন দেশ সোনালি ব্যাগে আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রয়োজনে বেসরকারিভাবেও এ ব্যাগ উৎপাদন সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে সরকারের নীতি সহায়তার প্রয়োজন হবে।
বিজেএমসির মুখ্য পরিচালন কর্মকর্তা মো. নাসিমুল ইসলাম বলেন, ২০২৫ সাল থেকেই আমরা বাণিজ্যিকভাবে সোনালি ব্যাগ তৈরি করতে পারবো। সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের পাইলট প্রকল্পও শেষ হয়েছে। ১০০ কোটি টাকার একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এর আওতায় বাণিজ্যিকভাবে শুরু হবে সোনালি ব্যাগ তৈরির কাজ।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পাট দিয়ে তৈরি সোনালি ব্যাগ দেশের পাটের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে অবদান রাখবে। সোনালি ব্যাগ পরিবেশবান্ধব। এ ব্যাগের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সোনালি ব্যাগ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিশ্বের প্যাকেজিংয়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে। এ ব্যাগ বহুল ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পাট মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সোনালি ব্যাগ দেখতে প্রচলিত পলিথিনের মতোই। এটি হালকা-পাতলা ও টেকসই। পাটের সূক্ষ্ম সেলুলোজ প্রক্রিয়াজাত করে এ ব্যাগ তৈরি করা হয়। পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ মাটিতে ফেললে তা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশ দূষিত হবে না। একটি ব্যাগ একাধিকবার ব্যবহার করা যায়।
সূত্র আরও জানায়, সোনালি আঁশখ্যাত পাট বাঙালির এক অনন্য গর্বের বিষয়। উন্নত প্রযুক্তি, গবেষণা ও শিল্পের মধ্য দিয়ে পাটের বহুমুখী ব্যবহার এবং অধিকতর মূল্য সংযোজনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফসল পাটের নির্যাস থেকে পলিথিনের বিকল্প পদার্থ তৈরি। এই গবেষণার ফসলকে শিল্পায়ন করে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিজেএমসি ২০১৭ সালে একটি গবেষণাভিত্তিক প্রাথমিক প্রকল্প গ্রহণ করে এবং পলিথিনের বিকল্প পাট থেকে পরিবেশবান্ধব ও পচনশীল ‘সোনালি ব্যাগ’ প্রস্তুত করে সীমিত আকারে বাজারজাত করতে সক্ষম হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ৫২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার অন্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি, ১৯ কোটি টাকার রাসায়নিক পদার্থ, সাড়ে ১৩ কোটি টাকার কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ কেনা হবে। এছাড়া গবেষণাগার সরঞ্জামাদি, ভবন ও স্থাপনা, পরামর্শকের সম্মানী, শ্রমিক ও আউটসোর্সিং খাতে ব্যয় করা হবে। প্রকল্পের মাধ্যমে পাট পলিমার থেকে উৎপাদিত শপিং ব্যাগসহ নিত্যপণ্যের মোড়কে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে সোনালি ব্যাগের বহুমুখী ব্যবহারসহ এ শিল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা সম্ভব হবে। কৃষকরা পাট উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন। দেশের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে এবং বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হবে। ফলে দারিদ্র্য বিমোচনসহ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। প্রকল্পের আওতায় ৫২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি, ১৯ কোটি টাকার রাসায়নিক পদার্থ, সাড়ে ১৩ কোটি টাকার কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ কেনা হবে। এছাড়া গবেষণাগার সরঞ্জামাদি, ভবন ও স্থাপনা, পরামর্শকের সম্মানী, শ্রমিক ও আউটসোর্সিং খাতে ব্যয় করা হবে।
বর্তমানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ব্যাগের ৪০ শতাংশই একবার ব্যবহৃত হয়। প্লাস্টিকের তৈরি ব্যাগ অপচনশীল হওয়ায় তা পরিবেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। এই প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে বেড়ে যায়, যা পরিবেশের অন্যতম ক্ষতির কারণ। প্লাস্টিকের ব্যাগ শুধু পরিবেশ নয়, মানবদেহের জন্যও ক্ষতিকর। ইতোমধ্যে মানবদেহে মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বিজেএমসি জানায়, ২০০২ সালে আমাদের দেশে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এর পরিবেশবান্ধব কোনো বিকল্প না থাকায় কার্যকরভাবে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ঢাকা শহরে বিভিন্নভাবে ক্রমাগত প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পরিবেশ দূষিত হওয়াসহ মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস, বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি ও নতুন রোগের সৃষ্টি, পলিথিন জমে জলাবদ্ধতা ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশের দূষণ কমাতে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের সেলুলোজ থেকে তৈরি এ সোনালি ব্যাগ ব্যবহৃত হতে পারে। ব্যাগটি বাহ্যিকভাবে পলিব্যাগের মতো দেখালেও এটি মাটিতে সম্পূর্ণ পচনশীল এবং পানিতে দ্রবণীয়। এটি খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের কাজেও ব্যবহার করা যায়। আগুনে পুড়লে ছাই হয়ে যায় কিন্তু বিষাক্ত কোনো গ্যাস তৈরি করে না। সোনালি ব্যাগের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া, এটি প্রয়োজনে রিসাইক্লিং করে দুই থেকে তিনবার ব্যবহার করাও সম্ভব। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে এককভাবে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের পাটের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত এবং সফল পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হলে, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একইভাবে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী ও উদ্বুদ্ধ হবেন। প্রকল্পটি লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব হবে বিধায় ছোট ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন এবং প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। পাটচাষিরা পাটের ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং অধিকহারে পাট উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন। ফলে সার্বিকভাবে কৃষক পর্যায়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বিভিন্নভাবে কার্যকরী অবদান রাখবে।
প্রতিবেদক/এএইচ/এসকে