
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আগপর্যন্ত ভারত তাঁর ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমন আশা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক কখনোই ‘নির্দিষ্ট সরকারকেন্দ্রিক’ হওয়া উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সাক্ষাৎকারটি সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত হয়েছে। দ্য হিন্দু জানিয়েছে, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারটি ওমানের রাজধানী মাসকাটে অষ্টম ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের (ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্স) ফাঁকে নেওয়া হয়েছে। নিচে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো:
দ্য হিন্দু: বাংলাদেশ–ভারতের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হলো। এ ব্যাপারে কিছু বলুন…
তৌহিদ হোসেন: সত্যি কথা বলতে, অন্তবর্তী সরকার যখন দায়িত্ব নেয় তখন দুই দেশের সম্পর্ক ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। কারণ ভারত গত ১৫ বছর ধরে এক ধরনের সম্পর্কে অভ্যস্থ ছিল। হঠাৎ সেখানে বিরাট ধাক্কা লাগে এবং সম্পর্কটি দ্রুত ভেঙে পড়ে। হয়তো নতুন বাস্তবতা মেনে নিতে সময় লেগেছ, সে কারণে নতুন সম্পর্কে অনেক প্রতিকূলতা ও অস্বস্তি ছিল। আমার মনে হয়, ছয় মাস পর এসব অস্বস্তি শেষ হওয়া উচিত। আমাদের এখন এমন একটি পরিবেশ প্রয়োজন যেখানে আমরা পরস্পরের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারি। ছয় মাস আগের তুলনায় আমরা এখন একে অপরের সঙ্গে ভালোভাবে যোগাযোগ তৈরি করতে পারি।
দ্য হিন্দু: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফর করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব। আপনি কি জয়শঙ্করের কাছে এসব উদ্বেগের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলেন?
তৌহিদ হোসেন: এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। কারণ এটা তো সম্পূর্ণ ভারতের ব্যাপার (তারা অন্য একটি দেশের সঙ্গে কী নিয়ে আলোচনা করেছে)। তবে আমার মনে হয় না খুব একটা উদ্বেগ থাকা উচিত। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বরং স্বাভাবিক হওয়া উচিত এবং ইতিমধ্যে সেটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়েছেও। উদাহরণ হিসেবে বাণিজ্যের কথা বলা যায়। অল্প সময়ের জন্য বাণিজ্যিক খাতে মন্দা দেখা দিলেও পরে আবার তা চাঙা হয়ে উঠেছে। এ সব ইঙ্গিত দেয় যে, অন্তত বেসরকারি খাতে দুই দেশের মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। আমাদের মনে রাখা দরকার, উভয় দেশেরই একে অপরের কাছে স্বার্থ রয়েছে এবং আমাদের এসব ব্যাপারে যত্ন নেওয়া উচিত।
দ্য হিন্দু: বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা নিয়ে ভারত বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আপনার কি মনে হয়, বাংলাদেশ সরকার এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে? এবং ভারত এ ব্যাপারে একমত? কারণ এটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তৌহিদ হোসেন: একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলা দরকার। সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের হিন্দু বা অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলিম বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মতোই সমান নাগরিক। তারা সমান অধিকার ও একই রকম সুরক্ষা পওয়ার অধিকার রাখে এবং তারা তা পায়। যেকোনো নাগরিকের মতোই সংখ্যালঘুদেরও সুরক্ষা দেওয়া সরকারের কাজ এবং সরকার সেটি করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর ভারতীয় গণমাধ্যমে এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যাতীত উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়, যার বেশির ভাগই মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। আপনাকে দুই দিন আগে প্রকাশিত জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনটি পড়ার অনুরোধ করছি। তাতে সবকিছু বলা হয়েছে (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল না)। তারা আমাদের অনুরোধে এসেছিল যাতে আমরা পরিস্থিতির ওপর সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সমীক্ষা পাই।
দ্য হিন্দু: আমি জাতিসংঘের কমিটির প্রতিবেদনটি পড়েছি। সেখানে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের বাড়াবাড়ি আচরণের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর প্রভাব সম্পর্কেও বলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার কি কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেবে?
তৌহিদ হোসেন: অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। আমরা জাতিসংঘের প্রতিবেদনের আগেই এ পদক্ষেপ নিয়েছি। এটি বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব এবং সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমি মনে করি না, এ ব্যাপারে ভারতের কথা বলা উচিত। কারণ এটি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের মনে রাখা দরকার, আমাদের উপদেষ্টা পরিষদে কমপক্ষে চারজন সদস্য আছেন, যাঁরা মানবাধিকারকর্মী এবং তাঁরা বহু বছর ধরে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে আসছেন। তাঁরা নিজেরাই সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন।
দ্য হিন্দু: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপারে ভারত কী পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করছেন?
তৌহিদ হোসেন: তাঁর (শেখ হাসিনা) বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য আমরা তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে ভারতকে অনুরোধ করেছি। সেটা যতক্ষণ পর্যন্ত ভারত না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আশা করব, ভারত অন্তত তাঁর ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করবে, যাতে তিনি উত্তেজনা সৃষ্টিকারী, মিথ্যা ও উসকানিমূলক বক্তব্য না দেন, যাতে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কারণ তাঁর গত ১৫ বছরের কর্মকাণ্ড এখনো মানুষের স্মৃতিতে তরতাজা। এ জন্য মানুষ এখনো ক্ষুব্ধ। তাই আমরা চাই, তিনি যেন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা না করেন।
দ্য হিন্দু: শেখ হাসিনার বক্তব্যের কারণে উত্তেজিত জনতাকে (মব) শেখ মুজিবের বাড়ি ভেঙে ফেলতে দেওয়ার অনুমতির পক্ষে আপনি কীভাবে যুক্তি দেবেন?
তৌহিদ হোসেন: একটি মব এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। তাতে সরকারের কোনো সমর্থন নেই।
দ্য হিন্দু: শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আপনার সরকার ভারতের কাছে শুধু একটি কূটনৈতিক নোট পাঠিয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে কি তাঁকে ফেরত চাওয়া হবে না?
তৌহিদ হোসেন: আমাদের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী আমরা অনেক অভিযুক্ত ভারতীয়কে বিচারের জন্য ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি মনে করি ভারতও তাঁকে (শেখ হাসিনা) বিচারের মুখোমুখি করার জন্য বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারে।
দ্য হিন্দু: কিন্তু প্রত্যর্পণ চুক্তির জন্য একটি বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ জন্য আপনার কাছে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্সের–এমএলএটি (পারস্পরিক আইনি সহায়তা) জন্য পর্যাপ্ত ওয়ারেন্ট থাকতে হবে। বাংলাদেশ কখন এই প্রক্রিয়া শুরু করার আশা করছে?
তৌহিদ হোসেন: হ্যাঁ। প্রক্রিয়াটি এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। মামলাগুলো এখন আদালতে। আমরা তাদেরকে এ ব্যাপারে তাড়া দিতে পারি না। আমরা এটিও জানি, তিনি ভারতের বিচারব্যবস্থার আশ্রয় নিতে পারেন। সুতরাং পুরো প্রক্রিয়াটিতে সময় লাগতে পারে। তাই আমরা চাই, তিনি ভারতে থাকারকালে কোনো উসকানিমূলক বা উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো বক্তব্য দেবেন না।
দ্য হিন্দু: সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয়ে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। জেলেদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে কথা বলেছেন পশ্চিবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া কিছু জেলের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাঁদের মারধর করা হয়েছে এবং তাঁরা গুরুতর আহত হয়েছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণেই কি এমনটি হলো?
তৌহিদ হোসেন: আমি সে রকম কিছু মনে করি না। আমি তেমনটি মনে করি না। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে সীমান্ত। ২০২৪ সালে সীমান্তে ২৪ জনকে গুলি করা হয়েছে, যার অর্ধেক বিগত সরকারের আমলে। বিশ্বের আর কোথাও এটা হয়নি। আমি মনে করি, আপনি আমার সঙ্গে এই বিষয়ে একমত হবেন। কারণ, ভারতীয় পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়, যেহেতু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়, সে কারণে এটা ঘটছে। বিশ্বের প্রতিটি সীমান্তেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়, কিন্তু কোথাও মানুষকে এভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় না। যদি অপরাধ ঘটে, আপনি তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করুন এবং আদালতে নিয়ে যান। কারাদণ্ড হোক বা আদালত যেকোনো রায় দিতে পারেন। কিন্তু আপনি তাঁকে হত্যা করতে পারেন না। সেখানে সীমান্তে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন সরকারের সময়ে কী ঘটছে। এটা এখনো বন্ধ হয়নি। এটা এমন একটি বিষয়, আমি মনে করি, ভারত যদি চায় থামাতে পারে এবং এটা বন্ধ করা উচিত। অন্য বিষয়গুলো সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত।
দ্য হিন্দু: বাংলাদেশ ও ভারত বেশ কয়েক বছর আগে একটি সমুদ্রচুক্তি করেছে। তারপরও এক দেশের জেলেদের অন্য দেশ গ্রেপ্তার করছে…
তৌহিদ হোসেন: আমি ঘটনাস্থলে যাইনি। তবে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে, আপনি জানেন জেলেরা মাছের দলকে অনুসরণ করেন। স্থলভাগে আপনার একটি নির্দিষ্ট সীমানা থাকে, আপনি জানেন যে এটাই সীমা। কিন্তু সমুদ্রে, এটা এত সহজ নয়। প্রায়ই উভয় দেশের জেলেরা পরস্পরের সামুদ্রিক অঞ্চলে প্রবেশ করে। আমাদের কিছু জেলে ভারতের হেফাজতে রয়েছে। আবার ভারতের কিছু জেলে আমাদের হেফাজতে রয়েছে। আমরা উভয় দেশই নির্দিষ্ট সময় পর তাদের মুক্ত করে দিই। খারাপ আচরণ করার বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যেই তদন্ত করতে বলেছি। যদি আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কেউ কেউ আসলেই জড়িত ছিলেন, অথবা তাঁরা যদি আইন ভঙ্গ করে থাকেন তাহলে অবশ্যই আমরা তা আমলে নেব। কিন্তু এটা সাধারণত করা হয় না। আমি চার বছরেরও বেশি সময় কলকাতায় কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেছি। জেলে বিনিময় নিয়ে কাজ করেছি। তাঁদের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করা হয়নি। যদি কোনো ব্যতিক্রম হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই আমরা খতিয়ে দেখব।
দ্য হিন্দু: সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ পেতে বাংলাদেশ সরকার আলোচনা করছে। আপনার কি মনে হয়, বাংলাদেশ সরকার আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎচুক্তি অব্যাহত রাখতে চায়?
তৌহিদ হোসেন: আমরা দুটি ধাপে আলোচনা করেছি। একটি চুক্তি স্বাক্ষরের আগে এবং আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরের পরে। সেই মোতাবেকই আমাদের এগোতে হবে। আমরা যদি মনে করি চুক্তিটি সঠিকভাবে হয়নি, তাহলে পারস্পরিকভাবে আবার এটি খতিয়ে দেখার ব্যাপারে সম্মত হতে পারি। আমার মতে, ব্যাপারটি নিয়ে আমরা আদানি গ্রুপের সঙ্গে কথা বলব এবং চুক্তিটিকে আরও যৌক্তিক করার চেষ্টা করব। আমি এ ব্যাপারে কোনো টেকনিক্যাল ব্যক্তি নই। তাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। তবে অন্যান্য চুক্তির সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, বিদ্যুতের দাম অস্বাভাবিক বেশি। সুতারাং চুক্তিটি নিয়ে আবারও সমঝোতা আলোচনা করা উচিত, বিশেষ করে কয়লা কেনার প্রশ্নে। যেকোনো যৌক্তিক ব্যক্তিই বলবেন যে, বিশ্ববাজারে সম্ভাব্য সর্বোত্তম দামে এই প্রকল্পের জন্য কয়লা কেনা উচিত। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। তাই এই জায়গাগুলোতে আমরা সম্ভবত ভালো মন নিয়ে আদানির সঙ্গে আলোচনা করতে পারি এবং আমরা তা করতে চাই। আপাতত আমরা বিদ্যুৎ দিতে অনুরোধ করেছি, কারণ আমাদের বিদ্যুৎ প্রয়োজন এবং তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহের ভিত্তিতে আমাদের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাই আমরা চাই, তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করুক এবং তারপর আমরা এর জন্য অর্থ পরিশোধ করব।
দ্য হিন্দু: আপনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দুবার সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে এখনও সাক্ষাৎ হয়নি। আগামী এপ্রিলে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে এই দুই নেতার মধ্যে বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন কী?
তৌহিদ হোসেন: এখন পর্যন্ত এই দুই নেতা একই সময়ে একই জায়গায় ছিলেন না। ফলে তাদের মধ্যে সাক্ষাতের কোনো সুযোগ হয়নি। তবে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, তারা দুজনেই মুক্ত মনে ও খোলামেলাভাবে আলোচনা করতে আগ্রহী। আমাদের এই অঞ্চলের সংস্কৃতিটা এমন, শীর্ষ কর্তারা যখন একসঙ্গে বসেন, তখন তাঁরা বছরের পর বছর ধরে আমাদের মতো লোকদের ওপর আলোচনার জন্য ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে, কেবল এক কথায় সমস্যার সমাধান করতে পারেন। এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে আমি বলতে পারি, তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক বৈঠক হওয়াটা ভালো। এই সরকারের শুরুতে তাঁরা একবার টেলিফোনে কথা বলেছেন। বিমসটেকে তাঁরা একই অনুষ্ঠানস্থলে থাকবেন। আমার জানা মতে, অন্যান্য দেশের সরকারপ্রধানেরাও থাকবেন। যদি তাঁরা সেখানে থাকেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবেন। কারণ এটি একটি ছোট গ্রুপ। উদাহরণস্বরূপ, সার্ক (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) শীর্ষ সম্মেলনে, সাত দেশের প্রত্যেক রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেন। তাই আমার মনে হয়, এরকম কিছু ঘটতে পারে।
দ্য হিন্দু: আপনি কি এ নিয়ে জয়শঙ্করের সঙ্গে কথা বলেছেন?
তৌহিদ হোসেন: আমি তো মাত্রই বললাম, এই বৈঠকের ব্যাপারে এখনো ঐকমত্য হয়নি। এ সব ব্যাপারে সাধারণত কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়ে গেলে, তার কয়েকদিন আগে আমরা বৈঠকের ব্যাপারগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নিই। দেকা যাক, কী হয়।
দ্য হিন্দু: পররাষ্ট্রনীতি এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে, বিশেষ করে ২০০৯ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকায়, আপনি কি মনে করেন ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্কের সেই অবস্থায় ফিরে আসতে পারে?
তৌহিদ হোসেন: ভালো বলেছেন। আমরা শুধু গত ১৫ বছর কেন দেখব? এমনকি বিএনপির আমলেও (১৯৯৬-২০০১) দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমি মনে করি না যে, দুই দেশের সম্পর্কটি নির্দিষ্ট সরকারকেন্দ্রিক হতে হবে। ১৯৯৬–৯৭ সালে দুই দেশের মধ্যে গঙ্গা চুক্তি হয়েছে। আমি মনে করি, দুই দেশে যে দলই সরকারের ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তা যেন পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব না ফেলে। এটা উচিত নয়। সম্পর্ক নির্ভর করে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বার্থের ওপর। আমি বিশ্বাস করি, উভয় পক্ষই বুঝতে পারছে তাদের স্বার্থ কী। ফরে আমরা ভারতের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি।
বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এসকে
সাক্ষাৎকারটি সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত হয়েছে। দ্য হিন্দু জানিয়েছে, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারটি ওমানের রাজধানী মাসকাটে অষ্টম ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের (ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্স) ফাঁকে নেওয়া হয়েছে। নিচে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো:
দ্য হিন্দু: বাংলাদেশ–ভারতের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হলো। এ ব্যাপারে কিছু বলুন…
তৌহিদ হোসেন: সত্যি কথা বলতে, অন্তবর্তী সরকার যখন দায়িত্ব নেয় তখন দুই দেশের সম্পর্ক ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। কারণ ভারত গত ১৫ বছর ধরে এক ধরনের সম্পর্কে অভ্যস্থ ছিল। হঠাৎ সেখানে বিরাট ধাক্কা লাগে এবং সম্পর্কটি দ্রুত ভেঙে পড়ে। হয়তো নতুন বাস্তবতা মেনে নিতে সময় লেগেছ, সে কারণে নতুন সম্পর্কে অনেক প্রতিকূলতা ও অস্বস্তি ছিল। আমার মনে হয়, ছয় মাস পর এসব অস্বস্তি শেষ হওয়া উচিত। আমাদের এখন এমন একটি পরিবেশ প্রয়োজন যেখানে আমরা পরস্পরের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারি। ছয় মাস আগের তুলনায় আমরা এখন একে অপরের সঙ্গে ভালোভাবে যোগাযোগ তৈরি করতে পারি।
দ্য হিন্দু: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফর করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব। আপনি কি জয়শঙ্করের কাছে এসব উদ্বেগের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলেন?
তৌহিদ হোসেন: এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। কারণ এটা তো সম্পূর্ণ ভারতের ব্যাপার (তারা অন্য একটি দেশের সঙ্গে কী নিয়ে আলোচনা করেছে)। তবে আমার মনে হয় না খুব একটা উদ্বেগ থাকা উচিত। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বরং স্বাভাবিক হওয়া উচিত এবং ইতিমধ্যে সেটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়েছেও। উদাহরণ হিসেবে বাণিজ্যের কথা বলা যায়। অল্প সময়ের জন্য বাণিজ্যিক খাতে মন্দা দেখা দিলেও পরে আবার তা চাঙা হয়ে উঠেছে। এ সব ইঙ্গিত দেয় যে, অন্তত বেসরকারি খাতে দুই দেশের মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। আমাদের মনে রাখা দরকার, উভয় দেশেরই একে অপরের কাছে স্বার্থ রয়েছে এবং আমাদের এসব ব্যাপারে যত্ন নেওয়া উচিত।
দ্য হিন্দু: বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা নিয়ে ভারত বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আপনার কি মনে হয়, বাংলাদেশ সরকার এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে? এবং ভারত এ ব্যাপারে একমত? কারণ এটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তৌহিদ হোসেন: একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলা দরকার। সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের হিন্দু বা অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলিম বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মতোই সমান নাগরিক। তারা সমান অধিকার ও একই রকম সুরক্ষা পওয়ার অধিকার রাখে এবং তারা তা পায়। যেকোনো নাগরিকের মতোই সংখ্যালঘুদেরও সুরক্ষা দেওয়া সরকারের কাজ এবং সরকার সেটি করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর ভারতীয় গণমাধ্যমে এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যাতীত উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়, যার বেশির ভাগই মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। আপনাকে দুই দিন আগে প্রকাশিত জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনটি পড়ার অনুরোধ করছি। তাতে সবকিছু বলা হয়েছে (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল না)। তারা আমাদের অনুরোধে এসেছিল যাতে আমরা পরিস্থিতির ওপর সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সমীক্ষা পাই।
দ্য হিন্দু: আমি জাতিসংঘের কমিটির প্রতিবেদনটি পড়েছি। সেখানে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের বাড়াবাড়ি আচরণের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর প্রভাব সম্পর্কেও বলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার কি কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেবে?
তৌহিদ হোসেন: অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। আমরা জাতিসংঘের প্রতিবেদনের আগেই এ পদক্ষেপ নিয়েছি। এটি বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব এবং সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমি মনে করি না, এ ব্যাপারে ভারতের কথা বলা উচিত। কারণ এটি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের মনে রাখা দরকার, আমাদের উপদেষ্টা পরিষদে কমপক্ষে চারজন সদস্য আছেন, যাঁরা মানবাধিকারকর্মী এবং তাঁরা বহু বছর ধরে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে আসছেন। তাঁরা নিজেরাই সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন।
দ্য হিন্দু: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপারে ভারত কী পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করছেন?
তৌহিদ হোসেন: তাঁর (শেখ হাসিনা) বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য আমরা তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে ভারতকে অনুরোধ করেছি। সেটা যতক্ষণ পর্যন্ত ভারত না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আশা করব, ভারত অন্তত তাঁর ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করবে, যাতে তিনি উত্তেজনা সৃষ্টিকারী, মিথ্যা ও উসকানিমূলক বক্তব্য না দেন, যাতে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কারণ তাঁর গত ১৫ বছরের কর্মকাণ্ড এখনো মানুষের স্মৃতিতে তরতাজা। এ জন্য মানুষ এখনো ক্ষুব্ধ। তাই আমরা চাই, তিনি যেন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা না করেন।
দ্য হিন্দু: শেখ হাসিনার বক্তব্যের কারণে উত্তেজিত জনতাকে (মব) শেখ মুজিবের বাড়ি ভেঙে ফেলতে দেওয়ার অনুমতির পক্ষে আপনি কীভাবে যুক্তি দেবেন?
তৌহিদ হোসেন: একটি মব এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। তাতে সরকারের কোনো সমর্থন নেই।
দ্য হিন্দু: শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আপনার সরকার ভারতের কাছে শুধু একটি কূটনৈতিক নোট পাঠিয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে কি তাঁকে ফেরত চাওয়া হবে না?
তৌহিদ হোসেন: আমাদের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী আমরা অনেক অভিযুক্ত ভারতীয়কে বিচারের জন্য ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি মনে করি ভারতও তাঁকে (শেখ হাসিনা) বিচারের মুখোমুখি করার জন্য বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারে।
দ্য হিন্দু: কিন্তু প্রত্যর্পণ চুক্তির জন্য একটি বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ জন্য আপনার কাছে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্সের–এমএলএটি (পারস্পরিক আইনি সহায়তা) জন্য পর্যাপ্ত ওয়ারেন্ট থাকতে হবে। বাংলাদেশ কখন এই প্রক্রিয়া শুরু করার আশা করছে?
তৌহিদ হোসেন: হ্যাঁ। প্রক্রিয়াটি এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। মামলাগুলো এখন আদালতে। আমরা তাদেরকে এ ব্যাপারে তাড়া দিতে পারি না। আমরা এটিও জানি, তিনি ভারতের বিচারব্যবস্থার আশ্রয় নিতে পারেন। সুতরাং পুরো প্রক্রিয়াটিতে সময় লাগতে পারে। তাই আমরা চাই, তিনি ভারতে থাকারকালে কোনো উসকানিমূলক বা উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো বক্তব্য দেবেন না।
দ্য হিন্দু: সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয়ে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। জেলেদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে কথা বলেছেন পশ্চিবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া কিছু জেলের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাঁদের মারধর করা হয়েছে এবং তাঁরা গুরুতর আহত হয়েছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণেই কি এমনটি হলো?
তৌহিদ হোসেন: আমি সে রকম কিছু মনে করি না। আমি তেমনটি মনে করি না। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে সীমান্ত। ২০২৪ সালে সীমান্তে ২৪ জনকে গুলি করা হয়েছে, যার অর্ধেক বিগত সরকারের আমলে। বিশ্বের আর কোথাও এটা হয়নি। আমি মনে করি, আপনি আমার সঙ্গে এই বিষয়ে একমত হবেন। কারণ, ভারতীয় পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়, যেহেতু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়, সে কারণে এটা ঘটছে। বিশ্বের প্রতিটি সীমান্তেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়, কিন্তু কোথাও মানুষকে এভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় না। যদি অপরাধ ঘটে, আপনি তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করুন এবং আদালতে নিয়ে যান। কারাদণ্ড হোক বা আদালত যেকোনো রায় দিতে পারেন। কিন্তু আপনি তাঁকে হত্যা করতে পারেন না। সেখানে সীমান্তে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন সরকারের সময়ে কী ঘটছে। এটা এখনো বন্ধ হয়নি। এটা এমন একটি বিষয়, আমি মনে করি, ভারত যদি চায় থামাতে পারে এবং এটা বন্ধ করা উচিত। অন্য বিষয়গুলো সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত।
দ্য হিন্দু: বাংলাদেশ ও ভারত বেশ কয়েক বছর আগে একটি সমুদ্রচুক্তি করেছে। তারপরও এক দেশের জেলেদের অন্য দেশ গ্রেপ্তার করছে…
তৌহিদ হোসেন: আমি ঘটনাস্থলে যাইনি। তবে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে, আপনি জানেন জেলেরা মাছের দলকে অনুসরণ করেন। স্থলভাগে আপনার একটি নির্দিষ্ট সীমানা থাকে, আপনি জানেন যে এটাই সীমা। কিন্তু সমুদ্রে, এটা এত সহজ নয়। প্রায়ই উভয় দেশের জেলেরা পরস্পরের সামুদ্রিক অঞ্চলে প্রবেশ করে। আমাদের কিছু জেলে ভারতের হেফাজতে রয়েছে। আবার ভারতের কিছু জেলে আমাদের হেফাজতে রয়েছে। আমরা উভয় দেশই নির্দিষ্ট সময় পর তাদের মুক্ত করে দিই। খারাপ আচরণ করার বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যেই তদন্ত করতে বলেছি। যদি আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কেউ কেউ আসলেই জড়িত ছিলেন, অথবা তাঁরা যদি আইন ভঙ্গ করে থাকেন তাহলে অবশ্যই আমরা তা আমলে নেব। কিন্তু এটা সাধারণত করা হয় না। আমি চার বছরেরও বেশি সময় কলকাতায় কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেছি। জেলে বিনিময় নিয়ে কাজ করেছি। তাঁদের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করা হয়নি। যদি কোনো ব্যতিক্রম হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই আমরা খতিয়ে দেখব।
দ্য হিন্দু: সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ পেতে বাংলাদেশ সরকার আলোচনা করছে। আপনার কি মনে হয়, বাংলাদেশ সরকার আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎচুক্তি অব্যাহত রাখতে চায়?
তৌহিদ হোসেন: আমরা দুটি ধাপে আলোচনা করেছি। একটি চুক্তি স্বাক্ষরের আগে এবং আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরের পরে। সেই মোতাবেকই আমাদের এগোতে হবে। আমরা যদি মনে করি চুক্তিটি সঠিকভাবে হয়নি, তাহলে পারস্পরিকভাবে আবার এটি খতিয়ে দেখার ব্যাপারে সম্মত হতে পারি। আমার মতে, ব্যাপারটি নিয়ে আমরা আদানি গ্রুপের সঙ্গে কথা বলব এবং চুক্তিটিকে আরও যৌক্তিক করার চেষ্টা করব। আমি এ ব্যাপারে কোনো টেকনিক্যাল ব্যক্তি নই। তাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। তবে অন্যান্য চুক্তির সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, বিদ্যুতের দাম অস্বাভাবিক বেশি। সুতারাং চুক্তিটি নিয়ে আবারও সমঝোতা আলোচনা করা উচিত, বিশেষ করে কয়লা কেনার প্রশ্নে। যেকোনো যৌক্তিক ব্যক্তিই বলবেন যে, বিশ্ববাজারে সম্ভাব্য সর্বোত্তম দামে এই প্রকল্পের জন্য কয়লা কেনা উচিত। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। তাই এই জায়গাগুলোতে আমরা সম্ভবত ভালো মন নিয়ে আদানির সঙ্গে আলোচনা করতে পারি এবং আমরা তা করতে চাই। আপাতত আমরা বিদ্যুৎ দিতে অনুরোধ করেছি, কারণ আমাদের বিদ্যুৎ প্রয়োজন এবং তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহের ভিত্তিতে আমাদের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাই আমরা চাই, তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করুক এবং তারপর আমরা এর জন্য অর্থ পরিশোধ করব।
দ্য হিন্দু: আপনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দুবার সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে এখনও সাক্ষাৎ হয়নি। আগামী এপ্রিলে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে এই দুই নেতার মধ্যে বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন কী?
তৌহিদ হোসেন: এখন পর্যন্ত এই দুই নেতা একই সময়ে একই জায়গায় ছিলেন না। ফলে তাদের মধ্যে সাক্ষাতের কোনো সুযোগ হয়নি। তবে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, তারা দুজনেই মুক্ত মনে ও খোলামেলাভাবে আলোচনা করতে আগ্রহী। আমাদের এই অঞ্চলের সংস্কৃতিটা এমন, শীর্ষ কর্তারা যখন একসঙ্গে বসেন, তখন তাঁরা বছরের পর বছর ধরে আমাদের মতো লোকদের ওপর আলোচনার জন্য ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে, কেবল এক কথায় সমস্যার সমাধান করতে পারেন। এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে আমি বলতে পারি, তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক বৈঠক হওয়াটা ভালো। এই সরকারের শুরুতে তাঁরা একবার টেলিফোনে কথা বলেছেন। বিমসটেকে তাঁরা একই অনুষ্ঠানস্থলে থাকবেন। আমার জানা মতে, অন্যান্য দেশের সরকারপ্রধানেরাও থাকবেন। যদি তাঁরা সেখানে থাকেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবেন। কারণ এটি একটি ছোট গ্রুপ। উদাহরণস্বরূপ, সার্ক (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) শীর্ষ সম্মেলনে, সাত দেশের প্রত্যেক রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেন। তাই আমার মনে হয়, এরকম কিছু ঘটতে পারে।
দ্য হিন্দু: আপনি কি এ নিয়ে জয়শঙ্করের সঙ্গে কথা বলেছেন?
তৌহিদ হোসেন: আমি তো মাত্রই বললাম, এই বৈঠকের ব্যাপারে এখনো ঐকমত্য হয়নি। এ সব ব্যাপারে সাধারণত কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়ে গেলে, তার কয়েকদিন আগে আমরা বৈঠকের ব্যাপারগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নিই। দেকা যাক, কী হয়।
দ্য হিন্দু: পররাষ্ট্রনীতি এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে, বিশেষ করে ২০০৯ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকায়, আপনি কি মনে করেন ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্কের সেই অবস্থায় ফিরে আসতে পারে?
তৌহিদ হোসেন: ভালো বলেছেন। আমরা শুধু গত ১৫ বছর কেন দেখব? এমনকি বিএনপির আমলেও (১৯৯৬-২০০১) দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমি মনে করি না যে, দুই দেশের সম্পর্কটি নির্দিষ্ট সরকারকেন্দ্রিক হতে হবে। ১৯৯৬–৯৭ সালে দুই দেশের মধ্যে গঙ্গা চুক্তি হয়েছে। আমি মনে করি, দুই দেশে যে দলই সরকারের ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তা যেন পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব না ফেলে। এটা উচিত নয়। সম্পর্ক নির্ভর করে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বার্থের ওপর। আমি বিশ্বাস করি, উভয় পক্ষই বুঝতে পারছে তাদের স্বার্থ কী। ফরে আমরা ভারতের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি।
বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এসকে