প্রবাদ আছে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। তবে চাল ও মাছের ঊর্ধ্বমুখী দামে সেই প্রবাদ যেন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। কেননা মাস খানেক ধরে অস্থির চালের বাজারে স্বস্তি ফেরেনি, বরং আরও বেড়েছে কোনো কোনো চালের দাম। তবে সেই আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে মুরগি, গরু-খাসিসহ অন্যান্য মাংস। এদিকে বাজারে চড়া ইলিশসহ অন্যান্য মাছের দামও। তবে বাজারে সবজিতে ভরপুর থাকায় কিছুটা স্বস্তিতে সাধারণ জনতা। শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বেশকটি বাজার ঘুরে এ চিত্র দেখা যায়।
চালের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে গত ২০ অক্টোবর এর ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, রেগুলেটরি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং আগাম কর ৫ শতাংশ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতেও দাম না কমায় গত ৩১ অক্টোবর চাল আমদানিতে শুল্ক পুরোপুরি তুলে নেয় সরকার। তবে এর কোনো প্রভাবই নেই বাজারে। আমনের এ ভরা মৌসুমে কমার বদলে উল্টো দফায় দফায় বাড়ছে চালের দাম। কিছুতেই বাজারের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। বাজারে এই নাজেহাল অবস্থার কথা শিকার করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) বলেন, রমজান সামনে রেখে সরকার বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। তবে সরকারের হাতে কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই, যার মাধ্যমে রাতারাতি বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। চালের বাজার নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে। বাজারে অন্য কোনো পণ্যে অসঙ্গতি নেই। চাল মজুতেও ঘাটতি নেই। এরপরেও চাল আমদানিতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। আমদানি শুল্ক ৬৩ শতাংশ থেকে তিন শতাংশে নামানো হয়েছে। এছাড়া এপ্রিল মাসে বোরো ধান উঠলে চালের বাজার স্বাভাবিক হবে।
চালের বাজারের এই নাজেহাল অবস্থায় বেকায়দায় নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তরাও। তারা জানান, আমনের ভরা মৌসুম হলেও চালের বাজারে অস্থিরতা কমছে না। এতে চাপ বাড়ছে ভোক্তার ঘাড়ে।রমিজ নামে এক ক্রেতা বলেন,বাজার এখন চালে ভরপুর; তবুও বাড়ছে দাম। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজার লুট করছে। আর পকেট কাটছে ভোক্তার। বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা শুধু মুখে বললেই হবে, মাঠ পর্যায়েও সরকারকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
চালের বাজারের এই অস্থিরতা অকপটে স্বীকার করেন খুচরা ব্যবসায়ীরাও। তারা বলেন, মিল পর্যায়ে চালের দাম বাড়ায় এর প্রভাব খুচরা পর্যায়েও পড়ছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বরিশাল রাইছ এজেন্সির বিক্রেতা জানান, বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট ৮০ টাকা, আটাইশ ৫৮-৬০ টাকা, মোটা স্বর্ণা ৫২-৫৬ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬-৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি পোলাও চাল বিক্রি হচ্ছে ১১৬-১১৮ টাকায়। তিনি আরও বলেন,মিনিকেটের দাম বাড়ছে। তবে সামান্য কমেছে নাজিরশাইলের দাম। মূলত চালের দাম বাড়ান মিল মালিকরা। আর সরকার অভিযান চালায় খুচরা বাজারে। এভাবে কখনোই চালের দাম কমানো সম্ভব না। দাম বাড়ায় কমেছে চালের বেচাকেনাও। বাড়তি দামের প্রভাবে মানুষ চাল কম কিনছেন।
বাঙালির কপালে চিন্তার ভাজ ফেলেছে ইলিশ
দেশের চালের বাজারের যখন এই হাল তখন মাছে-ভাতে বাঙালির কপালে চিন্তার ভাজ ফেলছে মাছের দামও। কেননা সপ্তাহ ব্যবধানে আরও অস্থির হয়েছে ইলিশের বাজার। কেজিপ্রতি ১০০-২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে সুস্বাদু এ রুপালি মাছ। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ইলিশ বিক্রেতা মো. শুকুর আলী বলেন, ইলিশ কম ধরা পড়ছে। এতে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বাড়ছে। দিন দিন ইলিশের দাম ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে কমছে বেচাবিক্রিও।তিনি আরও বলেন, বর্তমানে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৪০০-২৫০০ টাকায়। এছাড়া দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ৩২০০ টাকা, ১ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ২৮০০ টাকা, ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ২০০০-২২০০ টাকা হারে বিক্রি হচ্ছে, আর ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১২০০-১৩০০ টাকা ও ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের জন্য গুনতে হচ্ছে ৮০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত।
তবে অপরিবর্তিত রয়েছে অন্যান্য মাছের দাম। বাজারে প্রতি কেজি রুই ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, কাতল ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা, চাষের শিং ৫৫০ টাকা, চাষের মাগুর ৫০০ টাকা, চাষের কৈ ২৪০ থেকে ২৮০ টাকা, কোরাল ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, টেংরা ৫৫০ থেকে ৭০০ টাকা, চাষের পাঙাশ ১৮০ থেকে ২৩০ টাকা ও তেলাপিয়া ১৮০ থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া, প্রতি কেজি বোয়াল ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, পোয়া ৪৫০ টাকা, পাবদা ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, আইড় ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা, দেশি কৈ ১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা, শিং ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, শোল ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা এবং নদীর পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়।নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই। ক্রেতারা বলছেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হয় না। এতে বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর সুযোগ পান। আর বিক্রেতারা বলছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন। বাজারে নিয়মিত অভিযান চালালে অসাধুদের দৌরাত্ম্য কমবে।
গরু-মুরগির মাংসে স্থিতিশীল
এদিকে বাজারে গত সপ্তাহের মতোই স্থিতিশীল অবস্থা দেখা গেছে গরু-মুরগির মাংসের দামে। বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি কেজি খাসির মাংস ১০৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা ও ছাগলের মাংস বিক্রি হচ্ছে ১০০০ টাকায়। এছাড়াও প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত। দেশি মুরগি ৬৫০-৭০০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৫০ টাকা ও লাল লেয়ার বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায় এবং প্রতি কেজি সোনালী মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩২০ টাকায়।আনিসুল হক নামে এক ক্রেতা বলেন, ব্রয়লার মুরগি ২২০ টাকা কেজি, এটা একটু কমা দরকার। মাসখানেক আগেও ১৮০ টাকায় কিনেছি, এরপরই দাম বাড়তে শুরু করে। অথচ এই সময়ে কিন্তু খাদ্যের দামও বাড়তে শুনিনি। তারমানে দাম বাড়া-কমা নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের ওপর। তিনি বলেন, এক সময় বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে। এখন হাত বদল হয়ে আসছে অন্য দলের হাতে। মাঝখানে আমাদের সাধারণ মানুষের কিছুই হলো না।
মুরগির মাংস বিক্রেতা মনসুর আলী বলেন, শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় অন্যান্য দিনের তুলনায় এই দিনে মুরগির চাহিদাটা একটু বেশিই থাকে। তবে মুরগির দাম গত সপ্তাহের মতোই রয়ে গেছে। গত সপ্তাহেও ২১০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি করেছি। এই সপ্তাহেও একই দাম। শীতের আগে দামটা ২০০ টাকার নিচে ছিল। সম্ভবত শীতের কারণে বেড়েছে। কারণ সাধারণত শীতে কিছু মুরগি মরে যায় এবং রোগবালাইও বেশি হয়। যেকারণে খামারি পর্যায়েই বেশি দামে কিনে আনতে হয়।গরুর মাংস বিক্রেতা শান্ত ইসলাম বলেন, গরুর মাংস মোটামুটি ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকার মধ্যেই আটকে আছে। গত এক দেড় বছর ধরে এই দামেই বিক্রি করছি।
সবজিতে ভরপুর বাজার
গেল ২-৩ সপ্তাহ ধরে বাজারে কমেছে সবজির দাম। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে সবজির সরবরাহও বেড়েছে। নতুন টাটকা সবজিতে ভরে গেছে বাজার, ফলে কমেছে দামও ।তবে দুই একটি সবজির এখন মৌসুম না হওয়ায় সেগুলোর দাম কিছুটা বাড়তি যাচ্ছে। তারমধ্যে রয়েছে ঢেঁড়স, পটল, বরবটি। এগুলোর দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে বড় সাইজের ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়, একইভায়াবে প্রতি পিস বাধা কপিও বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়, লম্বা বেগুন প্রতি কেজি ৪০ টাকা, গোল বেগুন ৫০ টাকা, টমেটো ৬০ টাকা, পেঁপে ৫০ টাকা, শালগম ৩০ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকায় ও পেঁয়াজের ফুল প্রতি মুঠো ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি মুলা ২০ টাকা, গাজর ৬০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, শসা ৫০ টাকা, বিচি যুক্ত শিম ৬০ টাকা, সাধারণ শিম ৩০ টাকা, নতুন আলু ৪০ টাকা, নতুন লাল আলু ৫০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৬০ টাকা, কাঁচা টমেটো ৩০ টাকা এবং মিষ্টি কুমড়া ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রাজধানীর মহাখালী বাজারে বাজার করতে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে অন্যান্য জিনিসের তুলনায় সবজি কিনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হচ্ছে। কারণ বর্তমানে সবজির দাম কম যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও বাজারে ৮০ থেকে ১০০ টাকায় সব ধরনের সবজি বিক্রি হচ্ছিল, সেই তুলনায় এখন সবজির দাম কম। আমরা চাই সবজির এমন দামের মতো বাজারে অন্যান্য পণ্য সাধারণ ক্রেতাদের এমন ক্ষমতার মধ্যে আসুক।
রাজধানীর মগবাজার এলাকার সবজি বিক্রেতা জয়নাল হক বলেন, বাজারে একেবারে কমে গেছে সবজির দাম, ক্রেতারা ব্যাগ ভরে সবজি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তবে দু একটি সবজির বর্তমানে মৌসুম না হয়, সেগুলোর দাম একটু বেশি। বাকি সব সবজির দাম অনেক কমে গেছে বাজারে। এছাড়াও বাজারে টাটকা সবজির সরবরাহও অনেক বেশি, যে কারণে দাম কম যাচ্ছে। পুরো শীতকালীন সময়ে সবজির দাম এমন কম যাবে। সামনে আরো কমতে পারে সবজির দাম। সবজির দাম বিষয় কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা শরিফুল ইসলাম বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর পরিমাণে সবজি ঢাকায় আসছে প্রতিদিন। সব সবজি নতুন এবং টাটকা, আগের তুলনায় বাজারে প্রচুর পরিমাণে সবজির সরবরাহ হচ্ছে। যে কারণে বাজারে সবজির দাম কমে গেছে। কমপক্ষে আরো দেড় মাস সবজির দাম এমন কম থাকবে। এরপর থেকে কিছুটা বাড়তে শুরু করবে। রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোতে সবজির দাম বর্তমানে যা যাচ্ছে, এর চেয়েও আরো অনেক কম দাম কারওয়ানবাজারে। যেকোনো ক্রেতা অন্যান্য বাজারের চেয়ে কারওয়ানবাজার থেকে আরো অনেক কম দামে সবজি কিনতে পারবে।
দেশি পেঁয়াজ ৬০, ভারতীয় ৭০ টাকা
মৌসুমের নতুন পেঁয়াজ ওঠায় রাজধানীর বাজারগুলোতে দেশি পেঁয়াজে সয়লাব। বাজারের প্রতিটি দোকানে ছোট, মাঝারি ও বড় সাইজের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। আর কিছু কিছু দোকানে আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজেরও দেখা মিলেছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশি পেঁয়াজের দাম আগের মতোই অপরিবর্তিত রয়েছে। আর ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কমে আবার কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া পুরাতন দেশি পেঁয়াজ বা ক্রস জাতের পেঁয়াজ এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে না।
মার্কেটের পাইকারি ব্যবসায়ী খোরশেদ জানান, বেশ কিছুদিন হলো বাজারে দেশি পেঁয়াজ এসেছে। তাই দাম এখন অনেকটা কম। মাসখানেক আগেও এই পণ্যের দাম ১০০ টাকার ওপরে ছিল। আজকের বাজার অনুযায়ী পাবনার দেশি পেঁয়াজের দাম ৬০ টাকা এবং ভারতীয় বড় পেঁয়াজের দাম ৭০ টাকা।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজ ৬০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল। তার আগের সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজ ৫০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।
বাংলা স্কুপ/ প্রতিবেদক/ এনআইএন/এসকে
চালের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে গত ২০ অক্টোবর এর ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, রেগুলেটরি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং আগাম কর ৫ শতাংশ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতেও দাম না কমায় গত ৩১ অক্টোবর চাল আমদানিতে শুল্ক পুরোপুরি তুলে নেয় সরকার। তবে এর কোনো প্রভাবই নেই বাজারে। আমনের এ ভরা মৌসুমে কমার বদলে উল্টো দফায় দফায় বাড়ছে চালের দাম। কিছুতেই বাজারের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। বাজারে এই নাজেহাল অবস্থার কথা শিকার করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) বলেন, রমজান সামনে রেখে সরকার বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। তবে সরকারের হাতে কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই, যার মাধ্যমে রাতারাতি বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। চালের বাজার নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে। বাজারে অন্য কোনো পণ্যে অসঙ্গতি নেই। চাল মজুতেও ঘাটতি নেই। এরপরেও চাল আমদানিতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। আমদানি শুল্ক ৬৩ শতাংশ থেকে তিন শতাংশে নামানো হয়েছে। এছাড়া এপ্রিল মাসে বোরো ধান উঠলে চালের বাজার স্বাভাবিক হবে।
চালের বাজারের এই নাজেহাল অবস্থায় বেকায়দায় নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তরাও। তারা জানান, আমনের ভরা মৌসুম হলেও চালের বাজারে অস্থিরতা কমছে না। এতে চাপ বাড়ছে ভোক্তার ঘাড়ে।রমিজ নামে এক ক্রেতা বলেন,বাজার এখন চালে ভরপুর; তবুও বাড়ছে দাম। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজার লুট করছে। আর পকেট কাটছে ভোক্তার। বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা শুধু মুখে বললেই হবে, মাঠ পর্যায়েও সরকারকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
চালের বাজারের এই অস্থিরতা অকপটে স্বীকার করেন খুচরা ব্যবসায়ীরাও। তারা বলেন, মিল পর্যায়ে চালের দাম বাড়ায় এর প্রভাব খুচরা পর্যায়েও পড়ছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বরিশাল রাইছ এজেন্সির বিক্রেতা জানান, বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট ৮০ টাকা, আটাইশ ৫৮-৬০ টাকা, মোটা স্বর্ণা ৫২-৫৬ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬-৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি পোলাও চাল বিক্রি হচ্ছে ১১৬-১১৮ টাকায়। তিনি আরও বলেন,মিনিকেটের দাম বাড়ছে। তবে সামান্য কমেছে নাজিরশাইলের দাম। মূলত চালের দাম বাড়ান মিল মালিকরা। আর সরকার অভিযান চালায় খুচরা বাজারে। এভাবে কখনোই চালের দাম কমানো সম্ভব না। দাম বাড়ায় কমেছে চালের বেচাকেনাও। বাড়তি দামের প্রভাবে মানুষ চাল কম কিনছেন।
বাঙালির কপালে চিন্তার ভাজ ফেলেছে ইলিশ
দেশের চালের বাজারের যখন এই হাল তখন মাছে-ভাতে বাঙালির কপালে চিন্তার ভাজ ফেলছে মাছের দামও। কেননা সপ্তাহ ব্যবধানে আরও অস্থির হয়েছে ইলিশের বাজার। কেজিপ্রতি ১০০-২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে সুস্বাদু এ রুপালি মাছ। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ইলিশ বিক্রেতা মো. শুকুর আলী বলেন, ইলিশ কম ধরা পড়ছে। এতে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বাড়ছে। দিন দিন ইলিশের দাম ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে কমছে বেচাবিক্রিও।তিনি আরও বলেন, বর্তমানে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৪০০-২৫০০ টাকায়। এছাড়া দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ৩২০০ টাকা, ১ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ২৮০০ টাকা, ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ২০০০-২২০০ টাকা হারে বিক্রি হচ্ছে, আর ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১২০০-১৩০০ টাকা ও ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের জন্য গুনতে হচ্ছে ৮০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত।
তবে অপরিবর্তিত রয়েছে অন্যান্য মাছের দাম। বাজারে প্রতি কেজি রুই ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, কাতল ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা, চাষের শিং ৫৫০ টাকা, চাষের মাগুর ৫০০ টাকা, চাষের কৈ ২৪০ থেকে ২৮০ টাকা, কোরাল ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, টেংরা ৫৫০ থেকে ৭০০ টাকা, চাষের পাঙাশ ১৮০ থেকে ২৩০ টাকা ও তেলাপিয়া ১৮০ থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া, প্রতি কেজি বোয়াল ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, পোয়া ৪৫০ টাকা, পাবদা ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, আইড় ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা, দেশি কৈ ১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা, শিং ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, শোল ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা এবং নদীর পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়।নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই। ক্রেতারা বলছেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হয় না। এতে বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর সুযোগ পান। আর বিক্রেতারা বলছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন। বাজারে নিয়মিত অভিযান চালালে অসাধুদের দৌরাত্ম্য কমবে।
গরু-মুরগির মাংসে স্থিতিশীল
এদিকে বাজারে গত সপ্তাহের মতোই স্থিতিশীল অবস্থা দেখা গেছে গরু-মুরগির মাংসের দামে। বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি কেজি খাসির মাংস ১০৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা ও ছাগলের মাংস বিক্রি হচ্ছে ১০০০ টাকায়। এছাড়াও প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত। দেশি মুরগি ৬৫০-৭০০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৫০ টাকা ও লাল লেয়ার বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায় এবং প্রতি কেজি সোনালী মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩২০ টাকায়।আনিসুল হক নামে এক ক্রেতা বলেন, ব্রয়লার মুরগি ২২০ টাকা কেজি, এটা একটু কমা দরকার। মাসখানেক আগেও ১৮০ টাকায় কিনেছি, এরপরই দাম বাড়তে শুরু করে। অথচ এই সময়ে কিন্তু খাদ্যের দামও বাড়তে শুনিনি। তারমানে দাম বাড়া-কমা নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের ওপর। তিনি বলেন, এক সময় বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে। এখন হাত বদল হয়ে আসছে অন্য দলের হাতে। মাঝখানে আমাদের সাধারণ মানুষের কিছুই হলো না।
মুরগির মাংস বিক্রেতা মনসুর আলী বলেন, শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় অন্যান্য দিনের তুলনায় এই দিনে মুরগির চাহিদাটা একটু বেশিই থাকে। তবে মুরগির দাম গত সপ্তাহের মতোই রয়ে গেছে। গত সপ্তাহেও ২১০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি করেছি। এই সপ্তাহেও একই দাম। শীতের আগে দামটা ২০০ টাকার নিচে ছিল। সম্ভবত শীতের কারণে বেড়েছে। কারণ সাধারণত শীতে কিছু মুরগি মরে যায় এবং রোগবালাইও বেশি হয়। যেকারণে খামারি পর্যায়েই বেশি দামে কিনে আনতে হয়।গরুর মাংস বিক্রেতা শান্ত ইসলাম বলেন, গরুর মাংস মোটামুটি ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকার মধ্যেই আটকে আছে। গত এক দেড় বছর ধরে এই দামেই বিক্রি করছি।
সবজিতে ভরপুর বাজার
গেল ২-৩ সপ্তাহ ধরে বাজারে কমেছে সবজির দাম। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে সবজির সরবরাহও বেড়েছে। নতুন টাটকা সবজিতে ভরে গেছে বাজার, ফলে কমেছে দামও ।তবে দুই একটি সবজির এখন মৌসুম না হওয়ায় সেগুলোর দাম কিছুটা বাড়তি যাচ্ছে। তারমধ্যে রয়েছে ঢেঁড়স, পটল, বরবটি। এগুলোর দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে বড় সাইজের ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়, একইভায়াবে প্রতি পিস বাধা কপিও বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়, লম্বা বেগুন প্রতি কেজি ৪০ টাকা, গোল বেগুন ৫০ টাকা, টমেটো ৬০ টাকা, পেঁপে ৫০ টাকা, শালগম ৩০ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকায় ও পেঁয়াজের ফুল প্রতি মুঠো ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি মুলা ২০ টাকা, গাজর ৬০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, শসা ৫০ টাকা, বিচি যুক্ত শিম ৬০ টাকা, সাধারণ শিম ৩০ টাকা, নতুন আলু ৪০ টাকা, নতুন লাল আলু ৫০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৬০ টাকা, কাঁচা টমেটো ৩০ টাকা এবং মিষ্টি কুমড়া ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রাজধানীর মহাখালী বাজারে বাজার করতে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে অন্যান্য জিনিসের তুলনায় সবজি কিনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হচ্ছে। কারণ বর্তমানে সবজির দাম কম যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও বাজারে ৮০ থেকে ১০০ টাকায় সব ধরনের সবজি বিক্রি হচ্ছিল, সেই তুলনায় এখন সবজির দাম কম। আমরা চাই সবজির এমন দামের মতো বাজারে অন্যান্য পণ্য সাধারণ ক্রেতাদের এমন ক্ষমতার মধ্যে আসুক।
রাজধানীর মগবাজার এলাকার সবজি বিক্রেতা জয়নাল হক বলেন, বাজারে একেবারে কমে গেছে সবজির দাম, ক্রেতারা ব্যাগ ভরে সবজি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তবে দু একটি সবজির বর্তমানে মৌসুম না হয়, সেগুলোর দাম একটু বেশি। বাকি সব সবজির দাম অনেক কমে গেছে বাজারে। এছাড়াও বাজারে টাটকা সবজির সরবরাহও অনেক বেশি, যে কারণে দাম কম যাচ্ছে। পুরো শীতকালীন সময়ে সবজির দাম এমন কম যাবে। সামনে আরো কমতে পারে সবজির দাম। সবজির দাম বিষয় কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা শরিফুল ইসলাম বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর পরিমাণে সবজি ঢাকায় আসছে প্রতিদিন। সব সবজি নতুন এবং টাটকা, আগের তুলনায় বাজারে প্রচুর পরিমাণে সবজির সরবরাহ হচ্ছে। যে কারণে বাজারে সবজির দাম কমে গেছে। কমপক্ষে আরো দেড় মাস সবজির দাম এমন কম থাকবে। এরপর থেকে কিছুটা বাড়তে শুরু করবে। রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোতে সবজির দাম বর্তমানে যা যাচ্ছে, এর চেয়েও আরো অনেক কম দাম কারওয়ানবাজারে। যেকোনো ক্রেতা অন্যান্য বাজারের চেয়ে কারওয়ানবাজার থেকে আরো অনেক কম দামে সবজি কিনতে পারবে।
দেশি পেঁয়াজ ৬০, ভারতীয় ৭০ টাকা
মৌসুমের নতুন পেঁয়াজ ওঠায় রাজধানীর বাজারগুলোতে দেশি পেঁয়াজে সয়লাব। বাজারের প্রতিটি দোকানে ছোট, মাঝারি ও বড় সাইজের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। আর কিছু কিছু দোকানে আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজেরও দেখা মিলেছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশি পেঁয়াজের দাম আগের মতোই অপরিবর্তিত রয়েছে। আর ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কমে আবার কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া পুরাতন দেশি পেঁয়াজ বা ক্রস জাতের পেঁয়াজ এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে না।
মার্কেটের পাইকারি ব্যবসায়ী খোরশেদ জানান, বেশ কিছুদিন হলো বাজারে দেশি পেঁয়াজ এসেছে। তাই দাম এখন অনেকটা কম। মাসখানেক আগেও এই পণ্যের দাম ১০০ টাকার ওপরে ছিল। আজকের বাজার অনুযায়ী পাবনার দেশি পেঁয়াজের দাম ৬০ টাকা এবং ভারতীয় বড় পেঁয়াজের দাম ৭০ টাকা।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজ ৬০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল। তার আগের সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজ ৫০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।
বাংলা স্কুপ/ প্রতিবেদক/ এনআইএন/এসকে