রাজশাহীর সারদায় পুলিশ অ্যাকাডেমিতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে প্রশিক্ষণরত ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচের ৩২১ জন উপ-পরিদর্শককে (এসআই) অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গত বছরের ২১ অক্টোবর থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের প্রত্যেকের স্থায়ী ঠিকানায় এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে অব্যাহতির কারণ হিসেবে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে এ তথ্য জানা যায়।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পুলিশের ৪০তম ক্যাডেট এসআই ব্যাচে ৮৫৭ জন সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এরমধ্যে ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচে ৮২৩ জন এসআই সদস্যদের নিয়ে ট্রেনিং শুরু হয়েছিল। এরমধ্যে ১৯ জন বিভিন্ন কারণে ট্রেনিং থেকে চলে যায়। সেখান প্রশিক্ষণরত অবস্থায় বিভিন্ন সময় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ৩২১ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অব্যাহতি পাওয়া ৩২১ জনের মধ্যে ২৮৮ জন পুরুষ এবং ৩৩ জন নারী। ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করে পাসিং আউট নিয়ে বিভিন্ন ইউনিটে যোগদানের কথা ছিল। তবে এখনও প্রশিক্ষণরত এসআইদের পাসিং আউট দেওয়া হয়নি। এ ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষে সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানও স্থগিত করা হয়।
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে প্রশিক্ষণরত ৪০তম ক্যাডেট এসআইদের মধ্যে সর্বপ্রথম ২১ অক্টোবর ২৫২ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর ৪ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় ৫৮ জনকে, ১৮ নভেম্বর তৃতীয় দফায় ৩ জন এবং চতুর্থ দফায় ১ জানুয়ারি ৮ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সর্বপ্রথম গত বছরের ২১ অক্টাবর সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমিতে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণরত ২৫২ জন উপপরিদর্শককে (এসআই) অব্যাহতি দেওয়া হয়। অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষের পক্ষে পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন অ্যান্ড লজিস্টিক) তারেক বিন রশিদের সই করা চিঠিতে এ আদেশ দেওয়া হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমি প্যারেড মাঠে ১ অক্টোবর সকাল ৭টা ২৫ মিনিট থেকে ৪০তম বিসিএস (পুলিশ) প্রবেশনারস ব্যাচ ২০২৩ এর সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুশীলন প্যারেড কার্যক্রম চলমান ছিল। এ সময় বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমি সারদা, রাজশাহী পূর্বনির্ধারিত মেনু অনুযায়ী প্যারেডে অংশগ্রহণকারী সব প্রশিক্ষণার্থীর প্যারেড বিরতিতে সকালের নাশতা পরিবেশন করা হয়। কিন্তু আপনি (অভিযুক্ত এসআই) উক্ত সরবরাহকৃত নাশতা না খেয়ে হইচই করে মাঠের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। আপনি অন্য প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআইদের পরস্পর সংগঠিত করে অ্যাকাডেমি কর্তৃপক্ষকে হেয়প্রতিপন্ন করে চরম বিশৃঙ্খলা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে থাকেন। এছাড়া আপনি অন্যদের সঙ্গে হইচই করতে করতে নিজের খেয়াল-খুশি মতো প্রশিক্ষণ মাঠ থেকে বের হয়ে নিজ ব্যারাকে চলে যান। একজন প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআই হিসেবে এরূপ আচরণ এবং বিনা অনুমতিতে প্যারেড মাঠ থেকে বের হয়ে নিজ ব্যারাকে চলে যাওয়া সম্পূর্ণভাবে শৃঙ্খলাপরিপন্থি। আপনার এ রূপ আচরণ মাঠের সার্বিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে চরমভাবে ব্যাহত করেছে এবং অন্য প্রশিক্ষণার্থীদের শৃঙ্খলা ভঙ্গে উৎসাহিত করেছে মর্মে আপনার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে পুলিশ পরিদর্শক মহসিন আলী (বিপি- ৬৯/৮৭০০১৫২০) বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ (অতিরিক্ত আইজিপি) বরাবর লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।’
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘ওই অভিযোগের কারণে অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষের পক্ষে পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন অ্যান্ড লজিস্টিকস) তিন দিনের মধ্যে কৈফিয়তের জবাব দাখিল করার জন্য নির্দেশনা দেন। আপনি নির্ধারিত তিন দিন সময়ের মধ্যে কৈফিয়তের জবাব দাখিল করেন। আপনার দাখিলকৃত কৈফিয়তের জবাব পর্যালোচনান্তে সন্তোষজনক নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। আপনার উপরোক্ত শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পদ হিসেবে বিবেচিত সাব-ইন্সপেক্টর পদে কাজ করার পথে বড় ধরনের অন্তরায় ও অযোগ্যতার সামিল।’
পরবর্তীকালে দ্বিতীয় দফায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের একই অভিযোগ তুলে আরও দুই দফায় ৫৮ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর ৪ নভেম্বর তাদেরও অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে- প্রশিক্ষণ ক্লাসে এলোমেলোভাবে বসে হইচই করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও প্রশিক্ষণ মাঠে নিয়ম অমান্য করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়, ‘আপনি বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমি রাজশাহীতে ৪০তম ক্যাডেট এসআই ২০২৩ ব্যাচে গত ৫ নভেম্বর থেকে এক বছর মেয়াদি মৌলিক প্রশিক্ষণরত আছেন। ২১ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টা থেকে সাড়ে রাত ৮টায় চেমনি মেমোরিয়াল হলে প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআইদের ‘আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ধারার’ ওপর ক্লাস ছিল। ওই ক্লাসে আইন প্রশিক্ষক হিসেবে পুলিশ পরিদর্শক (নি.) রেজাউল করিম, নজরুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম ও শেখ শাহীন রাজা উপস্থিত ছিলেন। তারা ক্লাসে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান আসনে বসার সময় আপনি শৃঙ্খলার সঙ্গে না বসে এলোমেলোভাবে বসে হইচই করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন। রেজাউল করিমসহ সঙ্গীয় অন্য পরিদর্শকেরা বারবার শৃঙ্খলার সঙ্গে বসার কথা বললেও আপনি তাদের নির্দেশ অমান্য ও কর্ণপাত না করে হইচই করতে থাকেন। পাঠদান চলাকালে আপনার ক্লাসে কোনও মনোযোগ ছিল না এবং পাশাপাশি বসে কথাবার্তা বলছিলেন।’
নোটিশে আরও বলা হয়, ‘ক্লাস চলাকালে আপনার এ ধরনের শৃঙ্খলাবিরোধী আচরণ বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমির নিয়ম-শৃঙ্খলার পরিপন্থি মর্মে রেজাউল করিম বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষের বরাবর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করেন। আপনার এমন কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৩ সালের পিআরবি বিধি অনুযায়ী আপনাকে কেন চলমান মৌলিক প্রশিক্ষণ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে না, তার লিখিত ব্যাখ্যা তলবনামা প্রাপ্তির পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।’
এরপর চতুর্থ দফায় ১৮ নভেম্বর ৩ জন এবং পঞ্চম দফায় ১ জানুয়ারি ৮ জন প্রশিক্ষণার্থী এসআইকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে ক্লাসে শৃঙ্খলার সঙ্গে না বসে হইচই করার অভিযোগ এবং ‘মাঠে বিশৃঙ্খলার’ অভিযোগ আনা হয়।
অব্যাহতি পাওয়া কয়েকজন এসআই জানান, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঘটনা সাজিয়ে তাদের শোকজ করা হচ্ছে। যে ধরনের অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে ধরনের কোনও ঘটনা মাঠে ঘটেনি বলে দাবি অব্যাহতি পাওয়া ক্যাডেট এসআইদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, যে অভিযোগে আমাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সেদিন এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি। অভিযোগের বিষয়ে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারবে না সারদা কর্তৃপক্ষ। আমাদের অন্যায়ভাবে অব্যাহতি দেওয়া হলো। আরেকজন বলেন, ১২ মাসের জায়গায় তারা ১৪ মাস ধরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এ সময়ে তাদের সঙ্গে এসব অন্যায় করা হচ্ছে। নিয়মানুযায়ী গত বছরের ৪ নভেম্বর তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করে বিভিন্ন পুলিশ ইউনিটে যোগদানের কথা ছিল।
পুলিশ সূত্র জানায়, অব্যাহতি পাওয়া এসআইদের শৃঙ্খলা ভঙ্গ ছাড়াও এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে পুলিশ সদর দফতর এই ব্যাচের ৮০১ জন শিক্ষানবিশ এসআইয়ের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্ত করেছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি গোয়েন্দা সংস্থা এই তদন্ত করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ৩২১ জন ক্যাডেট এসআইয়ের একটি তালিকা করে সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষের কাছে পাঠানো হয় এবং তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
পুলিশে এসআই পদে চাকরির জন্য প্রার্থীকে শারীরিক, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। পরীক্ষা দিতে হয় কম্পিউটার চালানোর দক্ষতার ওপরও। এসব ধাপ পেরিয়ে প্রার্থীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এরপর চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থী ‘আউটসাইড ক্যাডেট’ হিসেবে সারদায় এক বছরের জন্য মৌলিক প্রশিক্ষণে অংশ নেন। সাধারণত অক্টোবর–নভেম্বর মাসে আউটসাইড ক্যাডেট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এই পাসিং আউটের পর মৌলিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসআইদের পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে মাঠপর্যায়ে কাজে পাঠানো হয়। সেখানে এক বছর পূর্ণ হলে তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয়।
সারদা থেকে অব্যাহতি পাওয়া ৩২১ জন এসআই চাকরি ফিরে পেতে গত রবি ও সোমবার (৫ ও ৬ জানুয়ারি) বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। সেখানে তারা চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। এর মধ্যে রবিউল ইসলাম নামে একজন বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব আমাদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া জন্য আশ্বস্ত করেছেন। তিনি আমাদের কাছ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় নিয়েছেন।’ তাদের চাকরিতে ফিরিয়ে নেওয়া না হলে ১২ জানুয়ারির পর কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুশিয়ারিও দেন তিনি।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশ অ্যাকাডেমি থেকে শৃঙ্খলাজনিত কারণে যদি কেউ আউট হয় তাদের আর নেওয়া হয় না। এটা শুধু আমাদের পুলিশ অ্যাকাডেমি বলে নয়। পৃথিবীর সব জায়গায় একই নিয়ম।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজশাহী সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমি পুরো এশিয়ার মধ্যে খুবই নাম করা। তাদের শৃঙ্খলাজনিত কারণে বের করা হয়েছে, সেটা যে সত্যি তার বড় প্রমাণ হচ্ছে তারা সচিবালয় এসে বিশৃঙ্খলা করছেন। তারা যদি শৃঙ্খলই হতেন তাহলে সঠিকভাবে বিষয়টা জানাতে পারতেন, আইজিপির কাছে যেতে পারতেন, কিন্তু যাননি। পুলিশ অ্যাকাডেমি যদি সঠিকভাবে তাদের আউট না করতো তাহলে সেটা লিখিতভাবে আইজিপিকে জানাতো। তারা সেটা করেননি, এটা তো ঠিক না। এটাই প্রমাণ করে তারা উচ্ছৃঙ্খল ছিল। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পুলিশ অ্যাকাডেমি শৃঙ্খল জায়গা। সেখানে অশৃঙ্খল কিছু করতে পারবেন না।’
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন/এসকে
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পুলিশের ৪০তম ক্যাডেট এসআই ব্যাচে ৮৫৭ জন সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এরমধ্যে ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচে ৮২৩ জন এসআই সদস্যদের নিয়ে ট্রেনিং শুরু হয়েছিল। এরমধ্যে ১৯ জন বিভিন্ন কারণে ট্রেনিং থেকে চলে যায়। সেখান প্রশিক্ষণরত অবস্থায় বিভিন্ন সময় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ৩২১ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অব্যাহতি পাওয়া ৩২১ জনের মধ্যে ২৮৮ জন পুরুষ এবং ৩৩ জন নারী। ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করে পাসিং আউট নিয়ে বিভিন্ন ইউনিটে যোগদানের কথা ছিল। তবে এখনও প্রশিক্ষণরত এসআইদের পাসিং আউট দেওয়া হয়নি। এ ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষে সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানও স্থগিত করা হয়।
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে প্রশিক্ষণরত ৪০তম ক্যাডেট এসআইদের মধ্যে সর্বপ্রথম ২১ অক্টোবর ২৫২ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর ৪ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় ৫৮ জনকে, ১৮ নভেম্বর তৃতীয় দফায় ৩ জন এবং চতুর্থ দফায় ১ জানুয়ারি ৮ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সর্বপ্রথম গত বছরের ২১ অক্টাবর সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমিতে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণরত ২৫২ জন উপপরিদর্শককে (এসআই) অব্যাহতি দেওয়া হয়। অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষের পক্ষে পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন অ্যান্ড লজিস্টিক) তারেক বিন রশিদের সই করা চিঠিতে এ আদেশ দেওয়া হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমি প্যারেড মাঠে ১ অক্টোবর সকাল ৭টা ২৫ মিনিট থেকে ৪০তম বিসিএস (পুলিশ) প্রবেশনারস ব্যাচ ২০২৩ এর সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুশীলন প্যারেড কার্যক্রম চলমান ছিল। এ সময় বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমি সারদা, রাজশাহী পূর্বনির্ধারিত মেনু অনুযায়ী প্যারেডে অংশগ্রহণকারী সব প্রশিক্ষণার্থীর প্যারেড বিরতিতে সকালের নাশতা পরিবেশন করা হয়। কিন্তু আপনি (অভিযুক্ত এসআই) উক্ত সরবরাহকৃত নাশতা না খেয়ে হইচই করে মাঠের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। আপনি অন্য প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআইদের পরস্পর সংগঠিত করে অ্যাকাডেমি কর্তৃপক্ষকে হেয়প্রতিপন্ন করে চরম বিশৃঙ্খলা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে থাকেন। এছাড়া আপনি অন্যদের সঙ্গে হইচই করতে করতে নিজের খেয়াল-খুশি মতো প্রশিক্ষণ মাঠ থেকে বের হয়ে নিজ ব্যারাকে চলে যান। একজন প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআই হিসেবে এরূপ আচরণ এবং বিনা অনুমতিতে প্যারেড মাঠ থেকে বের হয়ে নিজ ব্যারাকে চলে যাওয়া সম্পূর্ণভাবে শৃঙ্খলাপরিপন্থি। আপনার এ রূপ আচরণ মাঠের সার্বিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে চরমভাবে ব্যাহত করেছে এবং অন্য প্রশিক্ষণার্থীদের শৃঙ্খলা ভঙ্গে উৎসাহিত করেছে মর্মে আপনার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে পুলিশ পরিদর্শক মহসিন আলী (বিপি- ৬৯/৮৭০০১৫২০) বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ (অতিরিক্ত আইজিপি) বরাবর লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।’
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘ওই অভিযোগের কারণে অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষের পক্ষে পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন অ্যান্ড লজিস্টিকস) তিন দিনের মধ্যে কৈফিয়তের জবাব দাখিল করার জন্য নির্দেশনা দেন। আপনি নির্ধারিত তিন দিন সময়ের মধ্যে কৈফিয়তের জবাব দাখিল করেন। আপনার দাখিলকৃত কৈফিয়তের জবাব পর্যালোচনান্তে সন্তোষজনক নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। আপনার উপরোক্ত শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পদ হিসেবে বিবেচিত সাব-ইন্সপেক্টর পদে কাজ করার পথে বড় ধরনের অন্তরায় ও অযোগ্যতার সামিল।’
পরবর্তীকালে দ্বিতীয় দফায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের একই অভিযোগ তুলে আরও দুই দফায় ৫৮ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর ৪ নভেম্বর তাদেরও অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে- প্রশিক্ষণ ক্লাসে এলোমেলোভাবে বসে হইচই করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও প্রশিক্ষণ মাঠে নিয়ম অমান্য করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়, ‘আপনি বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমি রাজশাহীতে ৪০তম ক্যাডেট এসআই ২০২৩ ব্যাচে গত ৫ নভেম্বর থেকে এক বছর মেয়াদি মৌলিক প্রশিক্ষণরত আছেন। ২১ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টা থেকে সাড়ে রাত ৮টায় চেমনি মেমোরিয়াল হলে প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআইদের ‘আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ধারার’ ওপর ক্লাস ছিল। ওই ক্লাসে আইন প্রশিক্ষক হিসেবে পুলিশ পরিদর্শক (নি.) রেজাউল করিম, নজরুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম ও শেখ শাহীন রাজা উপস্থিত ছিলেন। তারা ক্লাসে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান আসনে বসার সময় আপনি শৃঙ্খলার সঙ্গে না বসে এলোমেলোভাবে বসে হইচই করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন। রেজাউল করিমসহ সঙ্গীয় অন্য পরিদর্শকেরা বারবার শৃঙ্খলার সঙ্গে বসার কথা বললেও আপনি তাদের নির্দেশ অমান্য ও কর্ণপাত না করে হইচই করতে থাকেন। পাঠদান চলাকালে আপনার ক্লাসে কোনও মনোযোগ ছিল না এবং পাশাপাশি বসে কথাবার্তা বলছিলেন।’
নোটিশে আরও বলা হয়, ‘ক্লাস চলাকালে আপনার এ ধরনের শৃঙ্খলাবিরোধী আচরণ বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমির নিয়ম-শৃঙ্খলার পরিপন্থি মর্মে রেজাউল করিম বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষের বরাবর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করেন। আপনার এমন কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৩ সালের পিআরবি বিধি অনুযায়ী আপনাকে কেন চলমান মৌলিক প্রশিক্ষণ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে না, তার লিখিত ব্যাখ্যা তলবনামা প্রাপ্তির পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।’
এরপর চতুর্থ দফায় ১৮ নভেম্বর ৩ জন এবং পঞ্চম দফায় ১ জানুয়ারি ৮ জন প্রশিক্ষণার্থী এসআইকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে ক্লাসে শৃঙ্খলার সঙ্গে না বসে হইচই করার অভিযোগ এবং ‘মাঠে বিশৃঙ্খলার’ অভিযোগ আনা হয়।
অব্যাহতি পাওয়া কয়েকজন এসআই জানান, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঘটনা সাজিয়ে তাদের শোকজ করা হচ্ছে। যে ধরনের অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে ধরনের কোনও ঘটনা মাঠে ঘটেনি বলে দাবি অব্যাহতি পাওয়া ক্যাডেট এসআইদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, যে অভিযোগে আমাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সেদিন এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি। অভিযোগের বিষয়ে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারবে না সারদা কর্তৃপক্ষ। আমাদের অন্যায়ভাবে অব্যাহতি দেওয়া হলো। আরেকজন বলেন, ১২ মাসের জায়গায় তারা ১৪ মাস ধরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এ সময়ে তাদের সঙ্গে এসব অন্যায় করা হচ্ছে। নিয়মানুযায়ী গত বছরের ৪ নভেম্বর তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করে বিভিন্ন পুলিশ ইউনিটে যোগদানের কথা ছিল।
পুলিশ সূত্র জানায়, অব্যাহতি পাওয়া এসআইদের শৃঙ্খলা ভঙ্গ ছাড়াও এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে পুলিশ সদর দফতর এই ব্যাচের ৮০১ জন শিক্ষানবিশ এসআইয়ের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্ত করেছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি গোয়েন্দা সংস্থা এই তদন্ত করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ৩২১ জন ক্যাডেট এসআইয়ের একটি তালিকা করে সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষের কাছে পাঠানো হয় এবং তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
পুলিশে এসআই পদে চাকরির জন্য প্রার্থীকে শারীরিক, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। পরীক্ষা দিতে হয় কম্পিউটার চালানোর দক্ষতার ওপরও। এসব ধাপ পেরিয়ে প্রার্থীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এরপর চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থী ‘আউটসাইড ক্যাডেট’ হিসেবে সারদায় এক বছরের জন্য মৌলিক প্রশিক্ষণে অংশ নেন। সাধারণত অক্টোবর–নভেম্বর মাসে আউটসাইড ক্যাডেট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এই পাসিং আউটের পর মৌলিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসআইদের পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে মাঠপর্যায়ে কাজে পাঠানো হয়। সেখানে এক বছর পূর্ণ হলে তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয়।
সারদা থেকে অব্যাহতি পাওয়া ৩২১ জন এসআই চাকরি ফিরে পেতে গত রবি ও সোমবার (৫ ও ৬ জানুয়ারি) বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। সেখানে তারা চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। এর মধ্যে রবিউল ইসলাম নামে একজন বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব আমাদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া জন্য আশ্বস্ত করেছেন। তিনি আমাদের কাছ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় নিয়েছেন।’ তাদের চাকরিতে ফিরিয়ে নেওয়া না হলে ১২ জানুয়ারির পর কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুশিয়ারিও দেন তিনি।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশ অ্যাকাডেমি থেকে শৃঙ্খলাজনিত কারণে যদি কেউ আউট হয় তাদের আর নেওয়া হয় না। এটা শুধু আমাদের পুলিশ অ্যাকাডেমি বলে নয়। পৃথিবীর সব জায়গায় একই নিয়ম।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজশাহী সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমি পুরো এশিয়ার মধ্যে খুবই নাম করা। তাদের শৃঙ্খলাজনিত কারণে বের করা হয়েছে, সেটা যে সত্যি তার বড় প্রমাণ হচ্ছে তারা সচিবালয় এসে বিশৃঙ্খলা করছেন। তারা যদি শৃঙ্খলই হতেন তাহলে সঠিকভাবে বিষয়টা জানাতে পারতেন, আইজিপির কাছে যেতে পারতেন, কিন্তু যাননি। পুলিশ অ্যাকাডেমি যদি সঠিকভাবে তাদের আউট না করতো তাহলে সেটা লিখিতভাবে আইজিপিকে জানাতো। তারা সেটা করেননি, এটা তো ঠিক না। এটাই প্রমাণ করে তারা উচ্ছৃঙ্খল ছিল। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পুলিশ অ্যাকাডেমি শৃঙ্খল জায়গা। সেখানে অশৃঙ্খল কিছু করতে পারবেন না।’
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন/এসকে