
চলতি বছর বাংলাদেশের ব়্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (ব়্যাব) প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পূর্তি হয়েছে৷ ব়্যাব আত্মপ্রকাশের তিন বছরের মাথায় ‘হলুদ হিমু কালো ব়্যাব' নামে একটি বই লিখেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ৷ আলোচিত এই বই নিয়ে ২০০৬ সালে হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নেন ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন৷ ব়্যাব নিয়ে ‘হিমু' চরিত্রের কাণ্ডকারখানা, বাহিনীটির বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং বইটি প্রকাশের পর তাদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন প্রয়াত এই লেখক। হুমায়ূন আহমেদের ৭৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য হুবহু প্রকাশ করা হলো৷
ডয়চে ভেলে : স্যার, আপনার এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস ‘হলুদ হিমু কালো ব়্যাব' নানা কারণে আলোচিত, একে তো ব়্যাবের এটি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে আর আপনার পাঠকপ্রিয়তা, জনপ্রিয়তা তো আকাশস্পর্শী৷ যে কারণে এটি আলোচনায় এসেছে, সেটি হচ্ছে, ব়্যাবের ইনভলভমেন্ট – এটি ব়্যাব মনে করছে৷ তো আপনি কী মনে করেন, কেন এটি আলোচনায় এলো?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমি তেমন কিছু মনে করি না, আমার প্রধান কাজ তো একটা বই লেখা, একটা বই লিখেছি, কী আলোচনা হচ্ছে না হচ্ছে এই বিষয়ে আমি এখনো পুরোপুরি জানি না৷ লেখা নিয়েই ব্যস্ত৷ লেখা যখন শেষ হবে তখন খোঁজ-খবর করে দেখবো ব্যাপারটা কী...
ডয়চে ভেলে : ব়্যাবের যেটা প্রধান দাবি- তারা বলতে চাচ্ছে, যে কারণেই হোক, নানা কারণে আপনার জনপ্রিয়তায় ধ্বস নেমেছে৷ এবং সেটাকে আপহোল্ড করার জন্য ব়্যাবের মতো একটি জনপ্রিয় বিষয়কে আপনি উপন্যাসে টেনে নিয়ে এসেছেন৷
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, ব়্যাবদের ধারণা ব়্যাবদের কাছে৷ ব়্যাবের ধারণার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক... মানে যোগাযোগ তো নাই৷ ব়্যাব ব়্যাবের কথা বলবে...
ডয়চে ভেলে : ব়্যাব এখন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে৷ তারা মেইনলি যে পার্টগুলো দেখছে, তাদের সঙ্গে কালও আমার কথা হয়েছে, আপনার অন্যান্য বিষয় নিয়ে তাদের ক্ষোভ রয়েছে বলে তারা বলছে, কিন্তু তারা একটি আপত্তিকর অংশ নিয়ে জনমনে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছে৷ সেটি হচ্ছে যে ‘আমার কৃষ্ণ ব়্যাব, আমি তোমায় ভালোবাসি৷ তোমার অস্ত্র, তোমার বুলেট আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী'৷ তারা মনে করছে, এটি জাতীয় সংগীতের প্যারোডি হয়েছে৷
হুমায়ূন আহমেদ : আমি সেটা মনে করি না৷ আমি মনে করি, এখানে যে চরিত্রটি আছে, হিমু, সে সমস্ত কিছু নিয়েই প্যারোডি করে৷ প্রহসনমূলক চরিত্র তো, তাই হিমু এবং তার আশেপাশে যারা থাকে, তারাও প্রহসনধর্মী কথা-বার্তা বলে৷ উপন্যাসের বিষয়বস্তু তো, আমার হিমু ধরনের উপন্যাসগুলি প্রহসনধর্মী উপন্যাস, ঠাট্টা, তামশা (তামাশা), ফাইজলামি (ফাজলামো) করা হিমুর স্বভাব এবং হিমুর আশেপাশে যারা থাকে তাদেরও সেই স্বভাব৷ যেই লোকটি এই কথাগুলো বলেছে, যে ব়্যাব সংগীত... সে মানসিকভাবে মোটামুটি বিপর্যস্ত একজন লোক৷ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত একজন লোক অনেক কিছুই বলতে পারে৷
ডয়চে ভেলে : আপনি সাধারণত হিমুর বইয়ে ভূমিকা লেখেন না, এই বইটি তে আপনার ছোট্ট একটি কৈফিয়ত রয়েছে, এখানে যে চরিত্রগুলো কাল্পনিক, কেন এই বইটিতে কৈফিয়তটি দিতে গেলেন? অন্য বইতে কেন দিলেন না?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমার অনেক বইয়ে কৈফিয়তধর্মী লেখা আছে, শুধু যে এটাতে আছে তা না কিন্তু... অনেক বইয়ে আছে৷ তবে এবার যে কয়টি উপন্যাস লিখেছি, প্রতিটাতেই ছোট না বড় কিছু না কিছু ভূমিকা আছে...
ডয়চে ভেলে : আপনার এ বইয়ের যে ক্যারেক্টারগুলো ... ব়্যাবের গোয়েন্দার যে ক্যারেক্টার রয়েছে, যে গোয়েন্দা হিমুর মেসে গিয়ে ঘুমায়, সে সেখানে ভাত খায়, যেটা একজন অথর্ব গোয়েন্দার চরিত্র, বাট মানবিক, আপনি কি মনে করেন ব়্যাবের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কটা এরকম?
হুমায়ূন আহমেদ : সমস্ত কিছু নিয়েই তো একটা বাহিনী, তুমি কি মনে করো যে, ব়্যাবে এমন লোকও আছে তারা ডাকাতি করছে? কিন্তু আমরা তো দেখি পত্রিকাতে তারা ডাকাতি করছে, করছে না? এরা যদি একদল এইখান থেকে বাইরে গিয়া যদি ডাকাতি করতে পারে, দু-একটা থাকতে পারে না যে সে ঘুমাবে? আমরা তো পত্রিকায় দেখেছি ডাকাতি করসে, অমুক বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে যাচ্ছে৷ অমুককে ভয় দেখাইয়া অস্ত্র নিচ্ছে, ব়্যাবের ....ওদের হাতে ব়্যাবের সদস্যরা ধরা পড়ছে৷ কাজেই এমন বিচিত্র জিনিস যদি থাকতে পারে, একজন থাকতেই পারে যে সেখানে ঘুমাচ্ছে৷ আর এইটা তো শুরুতেই বলসি, এইটা একটা প্রহসনধর্মী লেখা, একটা ফান করার উদ্দেশ্য এখানে সবসময়ই কাজ করেছে৷
ডয়চে ভেলে : আপনার হিমু তো এই প্রথমবার ব়্যাবের হাতে ধরা পড়লো৷ এবং দুইবার... এই উপন্যাসে হিমু দুইবার কিন্তু ব়্যাবের হাতে ধরা... নিয়ে যায়... প্রথমবার ধরা, তারপর নানা কারণে নিয়ে যায়৷ তো ব়্যাব গঠিত হয়েছে দু বছর, হিমু এত দেরি করলো কেন ব়্যাবের হাতে ধরা পড়তে?
হুমায়ূন আহমেদ : হিমুর এই বই এইমাত্রই লেখা হইলো তো, কাজেই ধরা পড়লো আর ব়্যাব গঠিত হওয়ার পরে পরেই তো আমরা ব়্যাবের কর্মকাণ্ড দেখতে পাইনি৷ আর ব়্যাব ছাড়াও হিমু কিন্তু সবসময়ই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে৷ আমার যে কয়টি উপন্যাস আছে, হিমুকে নিয়ে লেখা, আমি জানি না তুমি পড়েছো কিনা, প্রতিটা উপন্যাসেই হিমু কিছুটা সময় পুলিশের সাথে কাটায়, কাজেই এখানে কিছুটা সময় সে ব়্যাবের সঙ্গে কাটাইলো, নতুন কোনো বাহিনী যদি তৈরি হয়, মে বি কিছুটা সময় ও ওদের সঙ্গেও কাটাবে৷
ডয়চে ভেলে : আমরা কি আশা করতে পারি, হিমু নামের যুবকটি, যে যুবক অনেকেই হতে চায়, শোনা যায় আপনারও স্বপ্ন ছিল হিমুর মতো হওয়ার, এই হিমু আরো কিছুটা সময় ভবিষ্যতে ব়্যাবের সাথে কাটাবে?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি এখনো বুঝতে পারছি না, তবে কাটাইতেও পারে৷ সে প্রতি বইয়ে একবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, তো ব়্যাবের হাতে ধরা পড়তে সমস্যা কোথায়? ক্রসফায়ারে মারা না গেলেই হইসে আরকি৷
ডয়চে ভেলে : শেষ দিকে, শেষের যে চ্যাপ্টারটা, তার আগে ওই যে বিপর্যস্ত লোকটির কথা বলেছেন, যে হিমুর খালুৃ
হুমায়ূন আহমেদ : হু হু হু হু
ডয়চে ভেলে : এখানে প্রথমেই বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে ব়্যাবের হাতে, এবং সে এইটা কেন বলছে, মানে এইটার অবজার্ভেশনটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : মানে সেটা তো যে বলছে সে-ই সবচেয়ে ভালো জানে, সে তো চূড়ান্ত রকমের বিপর্যস্ত একটা লোক, মাইর-টাইর খাইয়া তার তো অবস্থা কাহিল, তাই না? তখন তার কাছে মনে হইসে যে, এই দেশকে ঠিক করার জন্য ব়্যাব লাগবে৷ কাজেই সেইটা তো তার দৃষ্টিভঙ্গি, তার চিন্তাধারা, এটা তো লেখকের চিন্তাধারা না৷ একটি উপন্যাসে দশটি ক্যারেক্টার থাকবে, দশটি ক্যারেক্টার দশভাবে কথা বলবে৷ এখন আমরা যদি মনে করি, দশটি ক্যারেক্টারে লেখকই কথা বলতেছে- সে তো ঠিক না৷ আমার কথা কী, আমার কথা ডেফিনিটলি রাষ্ট্র পরিচালনা ব়্যাবের কাছে থাকবে সেটা তো আমার কথা হইতে পারে না৷
ডয়চে ভেলে : বিষয়টা কি সেরকম ঘটতে যাচ্ছে?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমি কখনোই সেইটা মনে করি না৷
ডয়চে ভেলে : একটা ব়্যাব সংগীত থাকলে তো ভালো হয়- তিনি বলছেন, এবং একটি ব়্যাব দিবস, যেখানে কালো পোশাক পরে...
হুমায়ূন আহমেদ : আমরা সবাই মিছিল-টিছিল করবো... হুম...
ডয়চে ভেলে : তাহলে বিষয়টি তার দৃষ্টিতে যদি হয়, তাহলে ব়্যাব কি সর্বব্যাপ্ত হয়ে উঠছে?
হুমায়ূন আহমেদ : তার ইচ্ছা, সর্বব্যাপ্ত হয়ে উঠুক৷ আমাদের মধ্যে কিন্তু এমন অনেকেই আছে, যারা হয়ত বলবে যে, না ব়্যাব খুব ভালো কাজ করছে, অপরাধ কমছে৷ আছে না? অনেকেই বলবে৷ সে হচ্ছে সেই অনেকের একজন, যে ব়্যাবপ্রেমিক৷ ব়্যাবপ্রেমিক আছে না আমাদের মধ্যে? অনেকেই ব়্যাবপ্রেমিক আছে, হ্যাঁ? সে ব়্যাবপ্রেমিক, কাজেই সে ব়্যাবপ্রেমিক হিসেবে ব়্যাবদের কথা বলছে এবং ব়্যাবদের তো খুশি হওয়া উচিত যে, একজন প্রেমিক তাদের পক্ষে কথা বলছে৷
ডয়চে ভেলে : ব়্যাবের যে এই প্রেমিক জন, তার চরিত্রের কিন্তু একটা অদ্ভুত দিক আছে, যেটি আপনি খুব হালকাভাবে তুলে ধরলেও প্রচ-ভাবে নেগেটিভ এই লোকটি৷ মারধর খেয়ে, প্রতারণার শিকার হয়ে উনি মনে করলেন ব়্যাবই তার আশ্রয়৷
হুমায়ূন আহমেদ : না, একজন লোককে দিয়ে তো সবাইকে বিচার করা যাবে না, ওই বিশেষ লোকটি যে নির্যাতিত, নিপীড়িত, ইন আ সেন্স, উনি নিপীড়িত কাদের হাতে? সন্ত্রাসীদের হাতে৷ তো এরা তো চাইবে সন্ত্রাসটা দূর হয়ে যাক, সে যত খারাপ লোকই হোক, সে তো চাইবে দেশ থেকে সন্ত্রাস যাক৷ আচ্ছা, তুমি যদি রাস্তায় ইয়ের হাতে পড়ো, ডাকাইতের হাতে পড়ো, সেই ডাকাইত যদি র্যাব ধরে ফেলে, তুমি র্যাবের ওপর খুশি হবে না? যথেষ্ট পরিমাণে খুশি হবে৷ ওই লোকটা সেই পরিমাণেই খুশি হয়েছে৷
ডয়চে ভেলে : হিমুর মেসের যে কাজের ছেলেটা, জয়নাল, যে রান্নাবান্না করে, হিমু জীবিত হিসেবে যখন আবার ব্যাক করলো, ওই ছেলেটি তখন প্রচ- বিস্মিত হলো, তাহলে কি র্যাবের হাতে ধরা পড়লে কেউ জীবিত ফেরে না?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমাদের মধ্যে এই ধারণাটা কিন্তু আছে, সেটা তো তুমি জানো ভালো করে, জানো না অ্যাজ অ্যান ইন্টারভিউয়ার? আরে সর্বনাশ, ব়্যাব ধরে নিয়ে গেছে এখন তো শেষ- ওই সাধারণ ধারণাটাই আমার উপন্যাসে চলে এসেছে৷
ডয়চে ভেলে : রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা, হিমুর সাথে যে চীনা মেয়েটির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল৷ তো রেস্টুরেন্টে যে ভূত রেস্টুরেন্টের কথা আপনি বলেছেন, সেখানে কর্মচারীরা কালো পোশাক পরে এবং সেখানে ভূতনৃত্য হয়৷ বিষয়টা কী এমন ব়্যাব একটি ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করছে?
হুমায়ূন আহমেদ : না, ব়্যাব কী করেছে জানি না, তবে রেস্টুরেন্টটা করছে৷
ডয়চে ভেলে : কেন করে স্যার রেস্টুরেন্টে এসব?
হুমায়ূন আহমেদ : ওইটা রেস্টুরেন্টের মালিক বলতে পারবে, আমি বলতে পারবো না৷
ডয়চে ভেলে : ব্যক্তিগত জীবনে ব়্যাবের সঙ্গে কখনো কথা-বার্তা হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ : না, কখনো হয় নাই৷ ওহ আচ্ছা আচ্ছা, নুহাশ পল্লিতে একবার একদল ব়্যাব বেড়ানোর জন্য গিয়েছিল, দূর থেকে দেখেছি, আমার সাথে কোনো কথা-বার্তা হয় নাই৷
ডয়চে ভেলে : ওভার অল এই উপন্যাসটায় আপনার মেসেজটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার মেসেজ হচ্ছে যে, সর্ব প্রাণী সুখে থাকুক, আনন্দে থাকুক৷ আমার সমস্ত হিমু উপন্যাসেই একটা মেসেজ থাকে, যে জীবনটি আমাদের আছে, সেটি নিয়ে আমরা আনন্দে থাকি, আনন্দে বাস করি৷
ডয়চে ভেলে : নিশ্চয়ই চান হিমুও তার মতো আনন্দে থাকুক?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, সবাই আনন্দে থাকুক৷
ডয়চে ভেলে : তাহলে হিমু কেন ব়্যাবের হাতে ধরা পড়লো? সে তো কোনো অন্যায় করেনি?
হুমায়ূন আহমেদ : না, হিমু তো পুলিশের হাতেও অকেশনালি ধরা পড়ে, তখনো কোনো অন্যায় করে না৷ হিমুর তো কাজই ধরা পড়া, আমার তো স্টোরিটি তৈরি করতে এটার প্রয়োজন পড়ে৷ তার তো ইন্টারেকশনে যাইতে হবে... ব়্যাবের কাছে ধরা না পড়লে সে ইন্টারেকশনে যাবে কী করে?
ডয়চে ভেলে : তো ব়্যাবের সঙ্গেও হিমুর ইন্টারেকশন হবে?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, হিমু এমন একটা ক্যারেক্টার তার সবার সঙ্গে ইন্টারেকশন হয়৷ সে তো আমার মতো গর্তজীবী না, সে তো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়৷ যে লোকটা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, তার সঙ্গে তো বহু লোকের ইন্টারেকশন হবে৷
ডয়চে ভেলে : এবং ইন্টারেকশন হিমু তাদের সাধেই মেইনলি করে, প্রধান ইন্টারেকশন...
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, বইয়ের নামও তো ‘... কালো ব়্যাব', বইয়ের নাম তো অন্য কিছুও হইতে পারতো৷ যেহেতু বইয়ের নাম ‘হলুদ হিমু কালো ব়্যাব', কাজেই ব়্যাবের সঙ্গে তার একটা ইন্টারেকশন হবেই, নয়তো অন্য নাম দিতাম, শুধু দিতাম হলুদ হিমু৷
ডয়চে ভেলে : একজন যে ক্রসফায়ারে মারা গেল৷ তার কোমরের পাশে গুলি পাওয়া গেল, পিস্তল পাওয়া গেল, যেটি প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে৷ এই ধরনের ঘটনা কি বাস্তবেও ঘটেছে?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি তো পত্রিকায় দেখেছি৷ পত্রিকায় দেখেই তো লিখেছি৷
ডয়চে ভেলে : কী দেখেছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : এই জাতীয় নিউজ তো পত্রিকায় পড়েছি৷ না দেখে বলার তো প্রশ্নই ওঠে না, পত্রিকায় দেখছি, প্রায়ই লেখে ইয়ে পাওয়া যায় আবার সাথে৷
ডয়চে ভেলে : সেখানে প্রশ্নটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার প্রশ্নটা হইলো, এরা যে ইন্টারোগেশন করসে এতক্ষণ ধরে লোকটিকে, কখনো হাত দিয়ে দেখে নাই যে তার সাথে পিস্তল আছে বা গুলি আছে? প্রশ্নটি তো হিমু করেছে৷
ডয়চে ভেলে : দেশ পরিচালনার ভার আসলেই ব়্যাবের হাতে দিলে কেমন হয়?
হুমায়ূন আহমেদ : দেশ পরিচালনার ভার ব়্যাবের হাতে আমরা কেন দেবো, বলো৷ আমরা হচ্ছি, সারা জীবন আমরা কথা বলি গণতন্ত্রের জন্য, হঠাৎ করে যদি আমরা চিন্তা করি দেশ পরিচালনার ভার ব়্যাবের হাতে দেই, দিবো, সেইটা খুবই অন্যায় একটা কথা না?
ডয়চে ভেলে : ব়্যাব কি এভাবে চললে ভালো হবে?
হুমায়ূন আহমেদ : না, ডেফিনিটলি এভাবে চললে ভালো হবে না৷
ডয়চে ভেলে : কিভাবে চললে ভালো হবে?
হুমায়ূন আহমেদ : তাকে... তাকে... তাদের প্রতিটি কাজ-কর্মের একটা জবাবদিহিতা থাকতে হবে৷ একটা লোক ক্রসফায়ারে মারা যাবে, এসে বলবে যে ক্রসফায়ারে মারা গেল, এটা কখনোই হতে দেয়া যাবে না৷ যত বড় অপরাধীই হোক, অপরাধীর আত্মপক্ষের সমর্থনের একটা ব্যবস্থা থাকতেই হবে৷ তার একটা বিচারের অধিকার আছে৷ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি হচ্ছে বিচারের অধিকার৷ ওই বিচারটি তো তাকে দিতে হবে৷
ডয়চে ভেলে : ব়্যাবের যুক্তিটি হচ্ছে এবং আমাদের যে রাজনীতিবিদদের কথা বলেছেন, তাদের যুক্তিটি হচ্ছে এরকম যে, আপনার বইয়েও এসেছে যে, সমাজ থেকে ক্যানসার দূর করতে এছাড়া কীইবা করার ছিল৷
হুমায়ূন আহমেদ : সন্ত্রাসী বাড়ছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েছে৷ এবং এদের পিছনে নিশ্চয়ই বড় মদতদাতাও আছেন৷ তাছাড়া তো এভাবে সন্ত্রাসীরা তৈরি হতে পারে না৷ তো সেই অর্থে ক্যানসার শুধু আমাদেরকে না, সারা পৃথিবী জুড়েই ক্যানসার আছে, ওই ক্যানসারে কেমোথেরাপি দরকার, কাইটা বাদ দেয়ার পক্ষপাতী না৷
ডয়চে ভেলে : আপনি কি মনে করেন ব়্যাবের এই স্টাইলে সেটা নির্মূল করা সম্ভব?
হুমায়ূন আহমেদ : না আমার কাছে মনে হয় না কখনো৷ আমি লেখক মানুষ৷ আমি এ বিষয়ে সাজেশন কী দিবো? এ বিষয়ে সাজেশন দেবেন, যারা দেশ পরিচালনা করেন, তারা৷
ডয়চে ভেলে : ব়্যাব জঙ্গি দমনের সাফল্যের দাবি করছে, র্যাব সন্ত্রাস দমনের সাফল্যের দাবি করছে৷
হুমায়ূন আহমেদ : আমি তো ব়্যাবদের প্রতিবেদন তৈরি করছি না৷ আমি হিমুর প্রতিবেদন তৈরি করেছি৷ ব়্যাব যখন তাদের প্রতিবেদন তৈরি করবে, তখন তাতে তাদের সাফল্যের দিকগুলো মানুষকে ভালোভাবে জানাক৷ শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক ওদের সাফল্য নিয়ে৷ ওরা ওদের মতো চলুক, আমরা আমাদের মতো চলি৷
ডয়চে ভেলে : মানে, এই চলায় কারো জন্য বাধা না হোক...
হুমায়ূন আহমেদ : না, বাধা তো আসবেই, তাই বলে চলা বন্ধ করে দেবে কেউ?
ডয়চে ভেলে : ওরা যদি আপনার বিরুদ্ধে যদি আইনগত ব্যবস্থা নেয়?
হুমায়ূন আহমেদ : কিছু করার নেই৷ নিবে৷
ডয়চে ভেলে : আপনি কি স্যার জেলে যাবেন?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, জেলে যেতে আমার কোনো সমস্যা নাই৷ আমি জেলে যেতে চাচ্ছি, কারণ আমার জেলজীবনটা দেখার খুব শখ ছিল বহুদিন থেকেই৷
বাংলা স্কুপ/ডেস্ক/এসকে
ডয়চে ভেলে : স্যার, আপনার এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস ‘হলুদ হিমু কালো ব়্যাব' নানা কারণে আলোচিত, একে তো ব়্যাবের এটি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে আর আপনার পাঠকপ্রিয়তা, জনপ্রিয়তা তো আকাশস্পর্শী৷ যে কারণে এটি আলোচনায় এসেছে, সেটি হচ্ছে, ব়্যাবের ইনভলভমেন্ট – এটি ব়্যাব মনে করছে৷ তো আপনি কী মনে করেন, কেন এটি আলোচনায় এলো?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমি তেমন কিছু মনে করি না, আমার প্রধান কাজ তো একটা বই লেখা, একটা বই লিখেছি, কী আলোচনা হচ্ছে না হচ্ছে এই বিষয়ে আমি এখনো পুরোপুরি জানি না৷ লেখা নিয়েই ব্যস্ত৷ লেখা যখন শেষ হবে তখন খোঁজ-খবর করে দেখবো ব্যাপারটা কী...
ডয়চে ভেলে : ব়্যাবের যেটা প্রধান দাবি- তারা বলতে চাচ্ছে, যে কারণেই হোক, নানা কারণে আপনার জনপ্রিয়তায় ধ্বস নেমেছে৷ এবং সেটাকে আপহোল্ড করার জন্য ব়্যাবের মতো একটি জনপ্রিয় বিষয়কে আপনি উপন্যাসে টেনে নিয়ে এসেছেন৷
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, ব়্যাবদের ধারণা ব়্যাবদের কাছে৷ ব়্যাবের ধারণার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক... মানে যোগাযোগ তো নাই৷ ব়্যাব ব়্যাবের কথা বলবে...
ডয়চে ভেলে : ব়্যাব এখন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে৷ তারা মেইনলি যে পার্টগুলো দেখছে, তাদের সঙ্গে কালও আমার কথা হয়েছে, আপনার অন্যান্য বিষয় নিয়ে তাদের ক্ষোভ রয়েছে বলে তারা বলছে, কিন্তু তারা একটি আপত্তিকর অংশ নিয়ে জনমনে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছে৷ সেটি হচ্ছে যে ‘আমার কৃষ্ণ ব়্যাব, আমি তোমায় ভালোবাসি৷ তোমার অস্ত্র, তোমার বুলেট আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী'৷ তারা মনে করছে, এটি জাতীয় সংগীতের প্যারোডি হয়েছে৷
হুমায়ূন আহমেদ : আমি সেটা মনে করি না৷ আমি মনে করি, এখানে যে চরিত্রটি আছে, হিমু, সে সমস্ত কিছু নিয়েই প্যারোডি করে৷ প্রহসনমূলক চরিত্র তো, তাই হিমু এবং তার আশেপাশে যারা থাকে, তারাও প্রহসনধর্মী কথা-বার্তা বলে৷ উপন্যাসের বিষয়বস্তু তো, আমার হিমু ধরনের উপন্যাসগুলি প্রহসনধর্মী উপন্যাস, ঠাট্টা, তামশা (তামাশা), ফাইজলামি (ফাজলামো) করা হিমুর স্বভাব এবং হিমুর আশেপাশে যারা থাকে তাদেরও সেই স্বভাব৷ যেই লোকটি এই কথাগুলো বলেছে, যে ব়্যাব সংগীত... সে মানসিকভাবে মোটামুটি বিপর্যস্ত একজন লোক৷ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত একজন লোক অনেক কিছুই বলতে পারে৷
ডয়চে ভেলে : আপনি সাধারণত হিমুর বইয়ে ভূমিকা লেখেন না, এই বইটি তে আপনার ছোট্ট একটি কৈফিয়ত রয়েছে, এখানে যে চরিত্রগুলো কাল্পনিক, কেন এই বইটিতে কৈফিয়তটি দিতে গেলেন? অন্য বইতে কেন দিলেন না?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমার অনেক বইয়ে কৈফিয়তধর্মী লেখা আছে, শুধু যে এটাতে আছে তা না কিন্তু... অনেক বইয়ে আছে৷ তবে এবার যে কয়টি উপন্যাস লিখেছি, প্রতিটাতেই ছোট না বড় কিছু না কিছু ভূমিকা আছে...
ডয়চে ভেলে : আপনার এ বইয়ের যে ক্যারেক্টারগুলো ... ব়্যাবের গোয়েন্দার যে ক্যারেক্টার রয়েছে, যে গোয়েন্দা হিমুর মেসে গিয়ে ঘুমায়, সে সেখানে ভাত খায়, যেটা একজন অথর্ব গোয়েন্দার চরিত্র, বাট মানবিক, আপনি কি মনে করেন ব়্যাবের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কটা এরকম?
হুমায়ূন আহমেদ : সমস্ত কিছু নিয়েই তো একটা বাহিনী, তুমি কি মনে করো যে, ব়্যাবে এমন লোকও আছে তারা ডাকাতি করছে? কিন্তু আমরা তো দেখি পত্রিকাতে তারা ডাকাতি করছে, করছে না? এরা যদি একদল এইখান থেকে বাইরে গিয়া যদি ডাকাতি করতে পারে, দু-একটা থাকতে পারে না যে সে ঘুমাবে? আমরা তো পত্রিকায় দেখেছি ডাকাতি করসে, অমুক বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে যাচ্ছে৷ অমুককে ভয় দেখাইয়া অস্ত্র নিচ্ছে, ব়্যাবের ....ওদের হাতে ব়্যাবের সদস্যরা ধরা পড়ছে৷ কাজেই এমন বিচিত্র জিনিস যদি থাকতে পারে, একজন থাকতেই পারে যে সেখানে ঘুমাচ্ছে৷ আর এইটা তো শুরুতেই বলসি, এইটা একটা প্রহসনধর্মী লেখা, একটা ফান করার উদ্দেশ্য এখানে সবসময়ই কাজ করেছে৷
ডয়চে ভেলে : আপনার হিমু তো এই প্রথমবার ব়্যাবের হাতে ধরা পড়লো৷ এবং দুইবার... এই উপন্যাসে হিমু দুইবার কিন্তু ব়্যাবের হাতে ধরা... নিয়ে যায়... প্রথমবার ধরা, তারপর নানা কারণে নিয়ে যায়৷ তো ব়্যাব গঠিত হয়েছে দু বছর, হিমু এত দেরি করলো কেন ব়্যাবের হাতে ধরা পড়তে?
হুমায়ূন আহমেদ : হিমুর এই বই এইমাত্রই লেখা হইলো তো, কাজেই ধরা পড়লো আর ব়্যাব গঠিত হওয়ার পরে পরেই তো আমরা ব়্যাবের কর্মকাণ্ড দেখতে পাইনি৷ আর ব়্যাব ছাড়াও হিমু কিন্তু সবসময়ই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে৷ আমার যে কয়টি উপন্যাস আছে, হিমুকে নিয়ে লেখা, আমি জানি না তুমি পড়েছো কিনা, প্রতিটা উপন্যাসেই হিমু কিছুটা সময় পুলিশের সাথে কাটায়, কাজেই এখানে কিছুটা সময় সে ব়্যাবের সঙ্গে কাটাইলো, নতুন কোনো বাহিনী যদি তৈরি হয়, মে বি কিছুটা সময় ও ওদের সঙ্গেও কাটাবে৷
ডয়চে ভেলে : আমরা কি আশা করতে পারি, হিমু নামের যুবকটি, যে যুবক অনেকেই হতে চায়, শোনা যায় আপনারও স্বপ্ন ছিল হিমুর মতো হওয়ার, এই হিমু আরো কিছুটা সময় ভবিষ্যতে ব়্যাবের সাথে কাটাবে?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি এখনো বুঝতে পারছি না, তবে কাটাইতেও পারে৷ সে প্রতি বইয়ে একবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, তো ব়্যাবের হাতে ধরা পড়তে সমস্যা কোথায়? ক্রসফায়ারে মারা না গেলেই হইসে আরকি৷
ডয়চে ভেলে : শেষ দিকে, শেষের যে চ্যাপ্টারটা, তার আগে ওই যে বিপর্যস্ত লোকটির কথা বলেছেন, যে হিমুর খালুৃ
হুমায়ূন আহমেদ : হু হু হু হু
ডয়চে ভেলে : এখানে প্রথমেই বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে ব়্যাবের হাতে, এবং সে এইটা কেন বলছে, মানে এইটার অবজার্ভেশনটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : মানে সেটা তো যে বলছে সে-ই সবচেয়ে ভালো জানে, সে তো চূড়ান্ত রকমের বিপর্যস্ত একটা লোক, মাইর-টাইর খাইয়া তার তো অবস্থা কাহিল, তাই না? তখন তার কাছে মনে হইসে যে, এই দেশকে ঠিক করার জন্য ব়্যাব লাগবে৷ কাজেই সেইটা তো তার দৃষ্টিভঙ্গি, তার চিন্তাধারা, এটা তো লেখকের চিন্তাধারা না৷ একটি উপন্যাসে দশটি ক্যারেক্টার থাকবে, দশটি ক্যারেক্টার দশভাবে কথা বলবে৷ এখন আমরা যদি মনে করি, দশটি ক্যারেক্টারে লেখকই কথা বলতেছে- সে তো ঠিক না৷ আমার কথা কী, আমার কথা ডেফিনিটলি রাষ্ট্র পরিচালনা ব়্যাবের কাছে থাকবে সেটা তো আমার কথা হইতে পারে না৷
ডয়চে ভেলে : বিষয়টা কি সেরকম ঘটতে যাচ্ছে?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমি কখনোই সেইটা মনে করি না৷
ডয়চে ভেলে : একটা ব়্যাব সংগীত থাকলে তো ভালো হয়- তিনি বলছেন, এবং একটি ব়্যাব দিবস, যেখানে কালো পোশাক পরে...
হুমায়ূন আহমেদ : আমরা সবাই মিছিল-টিছিল করবো... হুম...
ডয়চে ভেলে : তাহলে বিষয়টি তার দৃষ্টিতে যদি হয়, তাহলে ব়্যাব কি সর্বব্যাপ্ত হয়ে উঠছে?
হুমায়ূন আহমেদ : তার ইচ্ছা, সর্বব্যাপ্ত হয়ে উঠুক৷ আমাদের মধ্যে কিন্তু এমন অনেকেই আছে, যারা হয়ত বলবে যে, না ব়্যাব খুব ভালো কাজ করছে, অপরাধ কমছে৷ আছে না? অনেকেই বলবে৷ সে হচ্ছে সেই অনেকের একজন, যে ব়্যাবপ্রেমিক৷ ব়্যাবপ্রেমিক আছে না আমাদের মধ্যে? অনেকেই ব়্যাবপ্রেমিক আছে, হ্যাঁ? সে ব়্যাবপ্রেমিক, কাজেই সে ব়্যাবপ্রেমিক হিসেবে ব়্যাবদের কথা বলছে এবং ব়্যাবদের তো খুশি হওয়া উচিত যে, একজন প্রেমিক তাদের পক্ষে কথা বলছে৷
ডয়চে ভেলে : ব়্যাবের যে এই প্রেমিক জন, তার চরিত্রের কিন্তু একটা অদ্ভুত দিক আছে, যেটি আপনি খুব হালকাভাবে তুলে ধরলেও প্রচ-ভাবে নেগেটিভ এই লোকটি৷ মারধর খেয়ে, প্রতারণার শিকার হয়ে উনি মনে করলেন ব়্যাবই তার আশ্রয়৷
হুমায়ূন আহমেদ : না, একজন লোককে দিয়ে তো সবাইকে বিচার করা যাবে না, ওই বিশেষ লোকটি যে নির্যাতিত, নিপীড়িত, ইন আ সেন্স, উনি নিপীড়িত কাদের হাতে? সন্ত্রাসীদের হাতে৷ তো এরা তো চাইবে সন্ত্রাসটা দূর হয়ে যাক, সে যত খারাপ লোকই হোক, সে তো চাইবে দেশ থেকে সন্ত্রাস যাক৷ আচ্ছা, তুমি যদি রাস্তায় ইয়ের হাতে পড়ো, ডাকাইতের হাতে পড়ো, সেই ডাকাইত যদি র্যাব ধরে ফেলে, তুমি র্যাবের ওপর খুশি হবে না? যথেষ্ট পরিমাণে খুশি হবে৷ ওই লোকটা সেই পরিমাণেই খুশি হয়েছে৷
ডয়চে ভেলে : হিমুর মেসের যে কাজের ছেলেটা, জয়নাল, যে রান্নাবান্না করে, হিমু জীবিত হিসেবে যখন আবার ব্যাক করলো, ওই ছেলেটি তখন প্রচ- বিস্মিত হলো, তাহলে কি র্যাবের হাতে ধরা পড়লে কেউ জীবিত ফেরে না?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমাদের মধ্যে এই ধারণাটা কিন্তু আছে, সেটা তো তুমি জানো ভালো করে, জানো না অ্যাজ অ্যান ইন্টারভিউয়ার? আরে সর্বনাশ, ব়্যাব ধরে নিয়ে গেছে এখন তো শেষ- ওই সাধারণ ধারণাটাই আমার উপন্যাসে চলে এসেছে৷
ডয়চে ভেলে : রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা, হিমুর সাথে যে চীনা মেয়েটির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল৷ তো রেস্টুরেন্টে যে ভূত রেস্টুরেন্টের কথা আপনি বলেছেন, সেখানে কর্মচারীরা কালো পোশাক পরে এবং সেখানে ভূতনৃত্য হয়৷ বিষয়টা কী এমন ব়্যাব একটি ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করছে?
হুমায়ূন আহমেদ : না, ব়্যাব কী করেছে জানি না, তবে রেস্টুরেন্টটা করছে৷
ডয়চে ভেলে : কেন করে স্যার রেস্টুরেন্টে এসব?
হুমায়ূন আহমেদ : ওইটা রেস্টুরেন্টের মালিক বলতে পারবে, আমি বলতে পারবো না৷
ডয়চে ভেলে : ব্যক্তিগত জীবনে ব়্যাবের সঙ্গে কখনো কথা-বার্তা হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ : না, কখনো হয় নাই৷ ওহ আচ্ছা আচ্ছা, নুহাশ পল্লিতে একবার একদল ব়্যাব বেড়ানোর জন্য গিয়েছিল, দূর থেকে দেখেছি, আমার সাথে কোনো কথা-বার্তা হয় নাই৷
ডয়চে ভেলে : ওভার অল এই উপন্যাসটায় আপনার মেসেজটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার মেসেজ হচ্ছে যে, সর্ব প্রাণী সুখে থাকুক, আনন্দে থাকুক৷ আমার সমস্ত হিমু উপন্যাসেই একটা মেসেজ থাকে, যে জীবনটি আমাদের আছে, সেটি নিয়ে আমরা আনন্দে থাকি, আনন্দে বাস করি৷
ডয়চে ভেলে : নিশ্চয়ই চান হিমুও তার মতো আনন্দে থাকুক?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, সবাই আনন্দে থাকুক৷
ডয়চে ভেলে : তাহলে হিমু কেন ব়্যাবের হাতে ধরা পড়লো? সে তো কোনো অন্যায় করেনি?
হুমায়ূন আহমেদ : না, হিমু তো পুলিশের হাতেও অকেশনালি ধরা পড়ে, তখনো কোনো অন্যায় করে না৷ হিমুর তো কাজই ধরা পড়া, আমার তো স্টোরিটি তৈরি করতে এটার প্রয়োজন পড়ে৷ তার তো ইন্টারেকশনে যাইতে হবে... ব়্যাবের কাছে ধরা না পড়লে সে ইন্টারেকশনে যাবে কী করে?
ডয়চে ভেলে : তো ব়্যাবের সঙ্গেও হিমুর ইন্টারেকশন হবে?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, হিমু এমন একটা ক্যারেক্টার তার সবার সঙ্গে ইন্টারেকশন হয়৷ সে তো আমার মতো গর্তজীবী না, সে তো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়৷ যে লোকটা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, তার সঙ্গে তো বহু লোকের ইন্টারেকশন হবে৷
ডয়চে ভেলে : এবং ইন্টারেকশন হিমু তাদের সাধেই মেইনলি করে, প্রধান ইন্টারেকশন...
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, বইয়ের নামও তো ‘... কালো ব়্যাব', বইয়ের নাম তো অন্য কিছুও হইতে পারতো৷ যেহেতু বইয়ের নাম ‘হলুদ হিমু কালো ব়্যাব', কাজেই ব়্যাবের সঙ্গে তার একটা ইন্টারেকশন হবেই, নয়তো অন্য নাম দিতাম, শুধু দিতাম হলুদ হিমু৷
ডয়চে ভেলে : একজন যে ক্রসফায়ারে মারা গেল৷ তার কোমরের পাশে গুলি পাওয়া গেল, পিস্তল পাওয়া গেল, যেটি প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে৷ এই ধরনের ঘটনা কি বাস্তবেও ঘটেছে?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি তো পত্রিকায় দেখেছি৷ পত্রিকায় দেখেই তো লিখেছি৷
ডয়চে ভেলে : কী দেখেছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : এই জাতীয় নিউজ তো পত্রিকায় পড়েছি৷ না দেখে বলার তো প্রশ্নই ওঠে না, পত্রিকায় দেখছি, প্রায়ই লেখে ইয়ে পাওয়া যায় আবার সাথে৷
ডয়চে ভেলে : সেখানে প্রশ্নটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার প্রশ্নটা হইলো, এরা যে ইন্টারোগেশন করসে এতক্ষণ ধরে লোকটিকে, কখনো হাত দিয়ে দেখে নাই যে তার সাথে পিস্তল আছে বা গুলি আছে? প্রশ্নটি তো হিমু করেছে৷
ডয়চে ভেলে : দেশ পরিচালনার ভার আসলেই ব়্যাবের হাতে দিলে কেমন হয়?
হুমায়ূন আহমেদ : দেশ পরিচালনার ভার ব়্যাবের হাতে আমরা কেন দেবো, বলো৷ আমরা হচ্ছি, সারা জীবন আমরা কথা বলি গণতন্ত্রের জন্য, হঠাৎ করে যদি আমরা চিন্তা করি দেশ পরিচালনার ভার ব়্যাবের হাতে দেই, দিবো, সেইটা খুবই অন্যায় একটা কথা না?
ডয়চে ভেলে : ব়্যাব কি এভাবে চললে ভালো হবে?
হুমায়ূন আহমেদ : না, ডেফিনিটলি এভাবে চললে ভালো হবে না৷
ডয়চে ভেলে : কিভাবে চললে ভালো হবে?
হুমায়ূন আহমেদ : তাকে... তাকে... তাদের প্রতিটি কাজ-কর্মের একটা জবাবদিহিতা থাকতে হবে৷ একটা লোক ক্রসফায়ারে মারা যাবে, এসে বলবে যে ক্রসফায়ারে মারা গেল, এটা কখনোই হতে দেয়া যাবে না৷ যত বড় অপরাধীই হোক, অপরাধীর আত্মপক্ষের সমর্থনের একটা ব্যবস্থা থাকতেই হবে৷ তার একটা বিচারের অধিকার আছে৷ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি হচ্ছে বিচারের অধিকার৷ ওই বিচারটি তো তাকে দিতে হবে৷
ডয়চে ভেলে : ব়্যাবের যুক্তিটি হচ্ছে এবং আমাদের যে রাজনীতিবিদদের কথা বলেছেন, তাদের যুক্তিটি হচ্ছে এরকম যে, আপনার বইয়েও এসেছে যে, সমাজ থেকে ক্যানসার দূর করতে এছাড়া কীইবা করার ছিল৷
হুমায়ূন আহমেদ : সন্ত্রাসী বাড়ছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েছে৷ এবং এদের পিছনে নিশ্চয়ই বড় মদতদাতাও আছেন৷ তাছাড়া তো এভাবে সন্ত্রাসীরা তৈরি হতে পারে না৷ তো সেই অর্থে ক্যানসার শুধু আমাদেরকে না, সারা পৃথিবী জুড়েই ক্যানসার আছে, ওই ক্যানসারে কেমোথেরাপি দরকার, কাইটা বাদ দেয়ার পক্ষপাতী না৷
ডয়চে ভেলে : আপনি কি মনে করেন ব়্যাবের এই স্টাইলে সেটা নির্মূল করা সম্ভব?
হুমায়ূন আহমেদ : না আমার কাছে মনে হয় না কখনো৷ আমি লেখক মানুষ৷ আমি এ বিষয়ে সাজেশন কী দিবো? এ বিষয়ে সাজেশন দেবেন, যারা দেশ পরিচালনা করেন, তারা৷
ডয়চে ভেলে : ব়্যাব জঙ্গি দমনের সাফল্যের দাবি করছে, র্যাব সন্ত্রাস দমনের সাফল্যের দাবি করছে৷
হুমায়ূন আহমেদ : আমি তো ব়্যাবদের প্রতিবেদন তৈরি করছি না৷ আমি হিমুর প্রতিবেদন তৈরি করেছি৷ ব়্যাব যখন তাদের প্রতিবেদন তৈরি করবে, তখন তাতে তাদের সাফল্যের দিকগুলো মানুষকে ভালোভাবে জানাক৷ শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক ওদের সাফল্য নিয়ে৷ ওরা ওদের মতো চলুক, আমরা আমাদের মতো চলি৷
ডয়চে ভেলে : মানে, এই চলায় কারো জন্য বাধা না হোক...
হুমায়ূন আহমেদ : না, বাধা তো আসবেই, তাই বলে চলা বন্ধ করে দেবে কেউ?
ডয়চে ভেলে : ওরা যদি আপনার বিরুদ্ধে যদি আইনগত ব্যবস্থা নেয়?
হুমায়ূন আহমেদ : কিছু করার নেই৷ নিবে৷
ডয়চে ভেলে : আপনি কি স্যার জেলে যাবেন?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, জেলে যেতে আমার কোনো সমস্যা নাই৷ আমি জেলে যেতে চাচ্ছি, কারণ আমার জেলজীবনটা দেখার খুব শখ ছিল বহুদিন থেকেই৷
বাংলা স্কুপ/ডেস্ক/এসকে