গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পতন হয় শেখ হাসিনার সরকারের। দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার আড়াই মাসের মাথায় আবারও আলোচনায় শেখ হাসিনার পদত্যাগ। সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে দেয়া একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারের সূত্র ধরেই সৃষ্টি হয়েছে নতুন বিতর্ক। ওই সময় প্রথমে সেনাপ্রধান এবং পরে তিন বাহিনীর প্রধানকে পেছনে রেখে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শেখ হাসিনা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তবে শেখ হাসিনা তা বরাবর অস্বীকার করে আসছেন। যদিও এখন রাষ্ট্রপতি জানান, তাঁর কাছে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের কোন লিখিত নেই। দেশত্যাগের কারণে সর্বোচ্চ আদালতের পরামর্শ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অথচ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি। গত শনিবার (১৯ অক্টোবর) মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে দেয়া একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি বলেন, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তাঁর কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই। সাক্ষাৎকারটি মানবজমিন পত্রিকার রাজনৈতিক ম্যাগাজিন সংস্করণ 'জনতার চোখ'-এ প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে থেকে রাষ্ট্রপতির এমন বক্তব্যের পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ছাত্র-জনতা থেকে শুরু করে দেশের সর্বসহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু রাষ্ট্রপতির বক্তব্য ও তাঁর শপথ লঙ্ঘনের বিষয়টি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে ‘মিথ্যাচার’ বলেছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সোমবার (২১ অক্টোবর) বিকেলে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা এ কথা বলেন। উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, রাষ্ট্রপতি যে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি, এটা হচ্ছে মিথ্যাচার এবং এটা হচ্ছে ওনার শপথ লঙ্ঘনের শামিল। কারণ, তিনি নিজেই ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং উনি তা গ্রহণ করেছেন। সরকার গঠনসহ আরও বিভিন্ন তথ্য উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, উনি (রাষ্ট্রপতি) আর এই পদে থাকার যোগ্যতা আছে কি না, সেই সম্পর্কে প্রশ্ন আসে।
ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা, যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেদিন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর দেন। সেদিন রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এবং আমি তা গ্রহণ করেছি। এরপর সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিয়ে নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সেই সরকারের শপথ পড়ান। তার আড়াই মাসের মাথায় গত ১৯ অক্টোবর মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের ‘কোনো দালিলিক প্রমাণ’ তার কাছে নেই।
এ নিয়ে নানা আলোচনার মধ্যে সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। সাংবদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি বলেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পান নাই, এটা হচ্ছে মিথ্যাচার, উনার শপথ লঙ্ঘনের সামিল। ঘটনার পরম্পরা ব্যাখ্যা করে আইন উপদেষ্টা বলেন, উনি নিজেই ৫ অগাস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে, পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী উনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং উনি সেটা গ্রহণ করেছেন। এরপর উনার কাছ থেকে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়- এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী আছে?
সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই উপদেশমূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করে জানতে চাওয়া হয়। এটার প্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতিরা মিলে উনারা একটা মতামত প্রদান করেন, রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের ভিত্তিতে। সেই মতামতের প্রথম লাইন হচ্ছে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ অ্যাপিলেট ডিভিশনের সব বিচারপতি স্বাক্ষর করেছেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, এর প্রেক্ষিতে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায় সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের এমন মতামতের ভিত্তিতে একটা নোট আইন মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে প্রেরণ করা হয়। এই অভিমতটা উনি দেখেছেন এবং গ্রহণ করেছেন, স্বাক্ষর করেছেন। এরপর উনি নিজে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছেন।
৫ আগস্ট রাত ১১টার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি ওটা গ্রহণ করেছেন এমন কথা বলে এবং একের পর এক কার্যাবলীর মধ্য দিয়ে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, উনি পুরো জাতিকে বার বার নিশ্চিত করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। প্রায় আড়াই মাস পরে উনি যদি বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র দেননি, তাহলে এটা স্ববিরোধিতা, শপথ লংঘন। উনি এই পদে থাকার যোগ্যতা আছে কিনা সে সম্পর্কে প্রশ্ন আসে। আসিফ নজরুল বলেন, আপনার যদি শারীরিক বা মানসিক সক্ষমতা না থাকে বা আপনি যদি গুরুতর অসদাচারণ করেন, তখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আর ওই পদে থাকতে পারেন কিনা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার স্কোপ আমাদের সংবিধানে আছে। সংবিধানের প্রথম পরিচ্ছেদের ৫৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে পদ থেকে অপসারণ করা যাবে। তবে সেজন্য সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হয়।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেছেন, রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেছেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর এ ভাষণ সারাদেশের মানুষ শুনেছে। রাষ্ট্রপতি নিজে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাদের শপথ পড়িয়েছেন। এখন তিনি বলছেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই। আমি বলবো, রাষ্ট্রপতি সরকার গঠনের দুই মাস পরে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে একথা বলেছেন। রাষ্ট্রপতি অসত্য কথা বলেছেন।
অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন আরও বলেন, এই সরকার গঠনের আগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে বৈধতা নেয়া হয়েছে। তাই পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা যদি পদত্যাগ নাও করেন অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বৈধতার সংকট নেই। আরেক প্রশ্নের জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, যেহেতু রাষ্ট্রপতির পদে থেকে তিনি অসত্য কথা বলেছেন, তাই দেশের মানুষ মনে করেন তার পদত্যাগ করা উচিত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া
দেশের জনগণ শেখ হাসিনার সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করায় তার পদত্যাগপত্রের ভূমিকা নেই বলে দাবি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। একই বিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার মন্তব্য, রাষ্ট্রপতির কাছে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছিল স্বৈরাচারী খুনি হাসিনা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পর ফেইসবুক পোস্টে এমন মন্তব্য করেন তারা।
সোমবার দুপুরে ফেইসবুক পোস্টে হাসনাত আব্দুল্লাহ লেখেন, একটি অবৈধ সরকারকে জনগণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করেছে। এখানে পদত্যাগপত্রের কোনো ভূমিকা নেই। এক ভিডিওবার্তায় হাসনাত বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শক্তির উত্থান ও পুনর্বাসন ঠেকাতে দলমত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। হাসনাত বলেন, আপনারা দেখেছেন রাষ্ট্রপতি বলেছেন শেখ হাসিনা তার কাছে কোনো পদত্যাগপত্র জমা দেননি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে পুনর্বাসন আবারও বিভিন্ন পাঁয়তারা শুরু করেছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গা স্বৈরাচারের পতিত আত্মারা বিভিন্ন জায়গায় জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেছে। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের আগে আমাদের একটাই পরিচয় ছিল আওয়ামী লীগ ছিল জালিম আর আমরা ছিলাম মজলুম। কিন্তু ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে আমরা পৃথক হয়েছে যার কারণে একটি গ্যাপ তৈরি হয়েছে। যার কারণে এই গ্যাপটির সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমাদের আবার একত্রিত হতে হবে। আমরা যদি দলীয় স্বার্থে যদি আলাদা হয়ে যাই তাহলে আওয়ামী লীগ আবারও সুযোগ নিবে। আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে।
রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের জবাবে হাসনাত আব্দুল্লাহর পোস্টের কিছু সময় পরেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেইসবুকে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছিলেন বলে মন্তব্য করে একটি পোস্ট করেন। পোস্টে তিনি লিখেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছিল স্বৈরাচারী খুনি হাসিনা। পদত্যাগপত্র নিয়ে বঙ্গভবনে যাওয়ার কথা থাকলেও ছাত্র-জনতা গণভবনের কাছাকাছি চলে আসলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় খুনি হাসিনা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মতো মানুষ যদি বলেন শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের ডকুমেন্টস তিনি রাখেননি, তাহলে তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা ছাত্রসমাজই নির্ধারণ করবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, রাষ্ট্রপতি যে দ্বিমুখী বক্তব্য দিয়েছেন তাতে স্পষ্ট যে তিনি শেখ হাসিনাকে বৈধতা দিতে চান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতির এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে বলেও উল্লেখ করেন মাহিন। তিনি বলেন, আমরা অফিসিয়ালি দ্রুতই আমাদের প্রতিক্রিয়া জানাব। দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাস এবং শহরে বিক্ষোভ হবে এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি আসবে।
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের ব্যাখ্যা
এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি মীমাংসিত এবং এ বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সোমবার রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক প্রেস রিলিজে এ তথ্য জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের উপপ্রেস সচিব শিপলু জামানের সই করা প্রেস রিলিজে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে তা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সুস্পস্ট বক্তব্য হলো, ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার ওপর যত ধরনের প্রশ্ন জনমনে উদ্রেক হয়েছে সেগুলোর যাবতীয় উত্তর স্পেশাল রেফারেন্স নং-০১/২০২৪ এ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গত ৮ আগস্টের আদেশে প্রতিফলিত হয়েছে।
সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চাওয়ার প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ এই মতামত দিয়েছিলেন বলে এতে উল্লেখ করা হয়। প্রেস রিলিজে আরও বলা হয়, মীমাংসিত এ বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্র্বতী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার জন্য রাষ্ট্রপতি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আপিল বিভাগের ওই স্পেশাল রেফারেন্সে বলা হয়েছিল, দেশের বর্তমান উদ্ভুত পরিস্থিতিতে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি গত ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, সেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করা সম্ভবপর নয়। এতে আরও বলা হয়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করার বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে ৮ আগস্টের একটি চিঠিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত যাচনা করা হয়েছে।
সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর মতে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র যদি সত্যিই জমা দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সেটির অনুলিপি কারো না কারো কাছে থাকার কথা। কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান চালালেও এর খোঁজ কেউ দিতে পারেনি তাকে। এমনকি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও যোগাযোগ করা হয়েছে, যেখানে সাধারণত প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু সেখানেও কিছু পাওয়া যায়নি। তাই শেষমেষ রাষ্ট্রপতির কাছেই সরাসরি এর উত্তর জানার সুযোগ মেলে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-আন্দোলন ও গণবিক্ষোভের মুখে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। সংবিধানের ৫৭(ক) ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন, তার কাছে শেখ হাসিনার কোনো পদত্যাগপত্র বা সংশ্লিষ্ট কোনো প্রমাণ পৌঁছায়নি। রাষ্ট্রপতির ভাষ্যে, আমি বহুবার পদত্যাগপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। হয়ত তার সময় হয়নি। কথোপকথনের সময় রাষ্ট্রপতি বলেন, ৫ আগস্ট সকাল ১০:৩০ টায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বঙ্গভবনে ফোন আসে, যেখানে বলা হয়েছিল যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাতের জন্য আসবেন। এরপরই বঙ্গভবনে প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে আরেকটি ফোন আসে যে তিনি (শেখ হাসিনা) আসছেন না। তিনি বলেন, চারদিকে অস্থিরতার খবর। কী হতে যাচ্ছে জানি না। আমি তো গুজবের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারি না। তাই সামরিক সচিব জেনারেল আদিলকে বললাম খোঁজ নিতে। তার কাছেও কোনো খবর নেই। আমরা অপেক্ষা করছি। টেলিভিশনের স্ক্রলও দেখছি। কোথাও কোনো খবর নেই। এক পর্যায়ে শুনলাম, তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমাকে কিছুই বলে গেলেন না।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কি না? একই জবাব। শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। মনে হয় সে সময় পাননি জানানোর। তিনি বলেন, সব কিছু যখন নিয়ন্ত্রণে এলো তখন একদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এলেন পদত্যাগপত্রের কপি সংগ্রহ করতে। তাকে বললাম, আমিও খুঁজছি। মতিউর রহমান চৌধুরীর সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, এ বিষয়ে আর বিতর্কের সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী চলে গেছেন এবং এটাই সত্য। তবুও, এই প্রশ্নটি যাতে আর কখনো না ওঠে তা নিশ্চিত করতে আমি সুপ্রিম কোর্টের মতামত চেয়েছি। রাষ্ট্রপতির পাঠানো রেফারেন্সের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ ৮ আগস্ট এ সম্পর্কে তাদের মতামত দেন। এতে বলা হয়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা দূর করতে এবং নির্বাহী কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টামণ্ডলীকে শপথবাক্য পাঠ করাতে পারবেন বলে আপিল বিভাগ মতামত দেন।
বাংলা স্কুপ/এএইচ /এসকে
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে ‘মিথ্যাচার’ বলেছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সোমবার (২১ অক্টোবর) বিকেলে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা এ কথা বলেন। উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, রাষ্ট্রপতি যে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি, এটা হচ্ছে মিথ্যাচার এবং এটা হচ্ছে ওনার শপথ লঙ্ঘনের শামিল। কারণ, তিনি নিজেই ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং উনি তা গ্রহণ করেছেন। সরকার গঠনসহ আরও বিভিন্ন তথ্য উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, উনি (রাষ্ট্রপতি) আর এই পদে থাকার যোগ্যতা আছে কি না, সেই সম্পর্কে প্রশ্ন আসে।
ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা, যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেদিন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর দেন। সেদিন রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এবং আমি তা গ্রহণ করেছি। এরপর সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিয়ে নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সেই সরকারের শপথ পড়ান। তার আড়াই মাসের মাথায় গত ১৯ অক্টোবর মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের ‘কোনো দালিলিক প্রমাণ’ তার কাছে নেই।
এ নিয়ে নানা আলোচনার মধ্যে সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। সাংবদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি বলেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পান নাই, এটা হচ্ছে মিথ্যাচার, উনার শপথ লঙ্ঘনের সামিল। ঘটনার পরম্পরা ব্যাখ্যা করে আইন উপদেষ্টা বলেন, উনি নিজেই ৫ অগাস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে, পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী উনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং উনি সেটা গ্রহণ করেছেন। এরপর উনার কাছ থেকে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়- এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী আছে?
সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই উপদেশমূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করে জানতে চাওয়া হয়। এটার প্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতিরা মিলে উনারা একটা মতামত প্রদান করেন, রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের ভিত্তিতে। সেই মতামতের প্রথম লাইন হচ্ছে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ অ্যাপিলেট ডিভিশনের সব বিচারপতি স্বাক্ষর করেছেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, এর প্রেক্ষিতে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায় সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের এমন মতামতের ভিত্তিতে একটা নোট আইন মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে প্রেরণ করা হয়। এই অভিমতটা উনি দেখেছেন এবং গ্রহণ করেছেন, স্বাক্ষর করেছেন। এরপর উনি নিজে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছেন।
৫ আগস্ট রাত ১১টার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি ওটা গ্রহণ করেছেন এমন কথা বলে এবং একের পর এক কার্যাবলীর মধ্য দিয়ে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, উনি পুরো জাতিকে বার বার নিশ্চিত করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। প্রায় আড়াই মাস পরে উনি যদি বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র দেননি, তাহলে এটা স্ববিরোধিতা, শপথ লংঘন। উনি এই পদে থাকার যোগ্যতা আছে কিনা সে সম্পর্কে প্রশ্ন আসে। আসিফ নজরুল বলেন, আপনার যদি শারীরিক বা মানসিক সক্ষমতা না থাকে বা আপনি যদি গুরুতর অসদাচারণ করেন, তখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আর ওই পদে থাকতে পারেন কিনা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার স্কোপ আমাদের সংবিধানে আছে। সংবিধানের প্রথম পরিচ্ছেদের ৫৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে পদ থেকে অপসারণ করা যাবে। তবে সেজন্য সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হয়।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেছেন, রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেছেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর এ ভাষণ সারাদেশের মানুষ শুনেছে। রাষ্ট্রপতি নিজে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাদের শপথ পড়িয়েছেন। এখন তিনি বলছেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই। আমি বলবো, রাষ্ট্রপতি সরকার গঠনের দুই মাস পরে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে একথা বলেছেন। রাষ্ট্রপতি অসত্য কথা বলেছেন।
অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন আরও বলেন, এই সরকার গঠনের আগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে বৈধতা নেয়া হয়েছে। তাই পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা যদি পদত্যাগ নাও করেন অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বৈধতার সংকট নেই। আরেক প্রশ্নের জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, যেহেতু রাষ্ট্রপতির পদে থেকে তিনি অসত্য কথা বলেছেন, তাই দেশের মানুষ মনে করেন তার পদত্যাগ করা উচিত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া
দেশের জনগণ শেখ হাসিনার সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করায় তার পদত্যাগপত্রের ভূমিকা নেই বলে দাবি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। একই বিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার মন্তব্য, রাষ্ট্রপতির কাছে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছিল স্বৈরাচারী খুনি হাসিনা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পর ফেইসবুক পোস্টে এমন মন্তব্য করেন তারা।
সোমবার দুপুরে ফেইসবুক পোস্টে হাসনাত আব্দুল্লাহ লেখেন, একটি অবৈধ সরকারকে জনগণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করেছে। এখানে পদত্যাগপত্রের কোনো ভূমিকা নেই। এক ভিডিওবার্তায় হাসনাত বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শক্তির উত্থান ও পুনর্বাসন ঠেকাতে দলমত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। হাসনাত বলেন, আপনারা দেখেছেন রাষ্ট্রপতি বলেছেন শেখ হাসিনা তার কাছে কোনো পদত্যাগপত্র জমা দেননি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে পুনর্বাসন আবারও বিভিন্ন পাঁয়তারা শুরু করেছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গা স্বৈরাচারের পতিত আত্মারা বিভিন্ন জায়গায় জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেছে। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের আগে আমাদের একটাই পরিচয় ছিল আওয়ামী লীগ ছিল জালিম আর আমরা ছিলাম মজলুম। কিন্তু ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে আমরা পৃথক হয়েছে যার কারণে একটি গ্যাপ তৈরি হয়েছে। যার কারণে এই গ্যাপটির সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমাদের আবার একত্রিত হতে হবে। আমরা যদি দলীয় স্বার্থে যদি আলাদা হয়ে যাই তাহলে আওয়ামী লীগ আবারও সুযোগ নিবে। আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে।
রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের জবাবে হাসনাত আব্দুল্লাহর পোস্টের কিছু সময় পরেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেইসবুকে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছিলেন বলে মন্তব্য করে একটি পোস্ট করেন। পোস্টে তিনি লিখেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছিল স্বৈরাচারী খুনি হাসিনা। পদত্যাগপত্র নিয়ে বঙ্গভবনে যাওয়ার কথা থাকলেও ছাত্র-জনতা গণভবনের কাছাকাছি চলে আসলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় খুনি হাসিনা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মতো মানুষ যদি বলেন শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের ডকুমেন্টস তিনি রাখেননি, তাহলে তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা ছাত্রসমাজই নির্ধারণ করবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, রাষ্ট্রপতি যে দ্বিমুখী বক্তব্য দিয়েছেন তাতে স্পষ্ট যে তিনি শেখ হাসিনাকে বৈধতা দিতে চান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতির এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে বলেও উল্লেখ করেন মাহিন। তিনি বলেন, আমরা অফিসিয়ালি দ্রুতই আমাদের প্রতিক্রিয়া জানাব। দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাস এবং শহরে বিক্ষোভ হবে এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি আসবে।
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের ব্যাখ্যা
এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি মীমাংসিত এবং এ বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সোমবার রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক প্রেস রিলিজে এ তথ্য জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের উপপ্রেস সচিব শিপলু জামানের সই করা প্রেস রিলিজে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে তা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সুস্পস্ট বক্তব্য হলো, ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার ওপর যত ধরনের প্রশ্ন জনমনে উদ্রেক হয়েছে সেগুলোর যাবতীয় উত্তর স্পেশাল রেফারেন্স নং-০১/২০২৪ এ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গত ৮ আগস্টের আদেশে প্রতিফলিত হয়েছে।
সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চাওয়ার প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ এই মতামত দিয়েছিলেন বলে এতে উল্লেখ করা হয়। প্রেস রিলিজে আরও বলা হয়, মীমাংসিত এ বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্র্বতী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার জন্য রাষ্ট্রপতি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আপিল বিভাগের ওই স্পেশাল রেফারেন্সে বলা হয়েছিল, দেশের বর্তমান উদ্ভুত পরিস্থিতিতে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি গত ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, সেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করা সম্ভবপর নয়। এতে আরও বলা হয়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করার বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে ৮ আগস্টের একটি চিঠিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত যাচনা করা হয়েছে।
সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর মতে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র যদি সত্যিই জমা দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সেটির অনুলিপি কারো না কারো কাছে থাকার কথা। কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান চালালেও এর খোঁজ কেউ দিতে পারেনি তাকে। এমনকি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও যোগাযোগ করা হয়েছে, যেখানে সাধারণত প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু সেখানেও কিছু পাওয়া যায়নি। তাই শেষমেষ রাষ্ট্রপতির কাছেই সরাসরি এর উত্তর জানার সুযোগ মেলে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-আন্দোলন ও গণবিক্ষোভের মুখে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। সংবিধানের ৫৭(ক) ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন, তার কাছে শেখ হাসিনার কোনো পদত্যাগপত্র বা সংশ্লিষ্ট কোনো প্রমাণ পৌঁছায়নি। রাষ্ট্রপতির ভাষ্যে, আমি বহুবার পদত্যাগপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। হয়ত তার সময় হয়নি। কথোপকথনের সময় রাষ্ট্রপতি বলেন, ৫ আগস্ট সকাল ১০:৩০ টায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বঙ্গভবনে ফোন আসে, যেখানে বলা হয়েছিল যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাতের জন্য আসবেন। এরপরই বঙ্গভবনে প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে আরেকটি ফোন আসে যে তিনি (শেখ হাসিনা) আসছেন না। তিনি বলেন, চারদিকে অস্থিরতার খবর। কী হতে যাচ্ছে জানি না। আমি তো গুজবের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারি না। তাই সামরিক সচিব জেনারেল আদিলকে বললাম খোঁজ নিতে। তার কাছেও কোনো খবর নেই। আমরা অপেক্ষা করছি। টেলিভিশনের স্ক্রলও দেখছি। কোথাও কোনো খবর নেই। এক পর্যায়ে শুনলাম, তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমাকে কিছুই বলে গেলেন না।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কি না? একই জবাব। শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। মনে হয় সে সময় পাননি জানানোর। তিনি বলেন, সব কিছু যখন নিয়ন্ত্রণে এলো তখন একদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এলেন পদত্যাগপত্রের কপি সংগ্রহ করতে। তাকে বললাম, আমিও খুঁজছি। মতিউর রহমান চৌধুরীর সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, এ বিষয়ে আর বিতর্কের সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী চলে গেছেন এবং এটাই সত্য। তবুও, এই প্রশ্নটি যাতে আর কখনো না ওঠে তা নিশ্চিত করতে আমি সুপ্রিম কোর্টের মতামত চেয়েছি। রাষ্ট্রপতির পাঠানো রেফারেন্সের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ ৮ আগস্ট এ সম্পর্কে তাদের মতামত দেন। এতে বলা হয়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা দূর করতে এবং নির্বাহী কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টামণ্ডলীকে শপথবাক্য পাঠ করাতে পারবেন বলে আপিল বিভাগ মতামত দেন।
বাংলা স্কুপ/এএইচ /এসকে