ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের মিটারিং বিভাগের বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানি ও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তারা একই জায়গায় বছরের পর বছর পদায়নে থেকে রাজধানীজুড়ে গড়ে তুলেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও যেন অনীহা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের।
ডিপিডিসি সূত্র জানায়, মূলত মিটারিং বিভাগে বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী গ্রাহক হয়রানি, দুর্নীতির মাধ্যমে থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও কালো টাকার মালিক হয়েছেন। তাই বদলির শঙ্কা দেখা দিলেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তা বাতিল করে দেন তাঁরা।
মিটারিং ডিভিশনের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, মূলত ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুনিম ইসলাম, সাব-ডিভিশনাল (এসডি) প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী, সহকারী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ আলামিন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেনসহ আরও কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছেন মিটারিং ডিভিশনের সিন্ডিকেট। বছরের পর বছর একই জায়গায় পদায়ন থেকে গড়ে তুলেছেন রাজধানীজুড়ে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কারণে গ্রাহক হয়রানি চরমে পৌঁছেছে। গ্রাহকের আঙ্গিনায় উচ্চচাপ মিটার সংযোগ চালু করতে গিয়ে গ্রাহকের কেনা ক্যাবল একটু নয়ছয় থাকলেই তারা গ্রাহককে চেপে ধরে টাকা দেয়ার জন্য। না হলে সংযোগ চালু করে না। এ যাবতীয় গ্রাহকের কাছ থেকে তারা ২৫ থেকে ৩০হাজার টাকা টাকা আদায় করে থাকে। উচ্চচাপ গ্রাহকদের মিটার সংযোগ করতে গিয়ে উৎকোচ না পেলেই এই চক্র নানান ফন্দি-ফিকির করে সংযোগ আটকে দেয়। অসহায় গ্রাহক তখন বাধ্য হয়েই তাদের উৎকোচ দেয়।
মিটারিং বিভাগের দক্ষিণের দায়িত্বে রয়েছেন সাব-ডিভিশনাল প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী (আইডি২১৫৮৩)। তাঁর চাকরি জীবনের ৯ বছরের ৮ বছরই তিনি কাজ করছেন এখানে। অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ডিপিডিসির মিটারিং বিভাগে অনিয়মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গড়ে তুলেছেন একচ্ছত্র আধিপত্য। তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডিপিডিসির সবচেয়ে লোভনীয় জায়গা হলো নারায়ণগঞ্জ বেল্ট। কেননা, এই এলাকার বেশিরভাগ গ্রাহকই শিল্পপ্রতিষ্ঠান। পলাশের অধীনে থাকা উপসহকারী প্রকৌশলী সিব্বির ও আবুল হোসেনের মাধ্যমে সে যত অনিয়ম করে অর্থ কামাচ্ছে। সূত্র আরও জানায়, নারায়ণগঞ্জ বেল্টে পলাশের সিন্ডিকেটে রয়েছে স্থানীয় দালাল কবির, মালেক, মিজান ও বাহার। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই পলাশ কৃষ্ণ টাকা কামাচ্ছেন। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই সিন্ডিকেটের অন্যায় আবদারে তাঁরা অতিষ্ঠ। তাঁরা আরও অভিযোগ করেন, এদের বিষয়ে ডিপিডিসির প্রধান কার্যালয়ে লিখিতভাবে জানানো হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরীকে এ বিষয়ে মুঠোফোনে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি কোন দুর্নীতি করি না। আমার নাম ব্যবহার করে আমার অধীনে থাকা প্রকৌশলীরা যদি মাঠপর্যায়ে কোন অনিয়ম-দুর্নীতি করে, তার দায় তো আমার না।
মিটারিং ডিভিশনের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, মিটারিং চক্রের আরেক সদস্য সহকারী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন দুর্নীতি করে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে তিনি বাংলাস্কুপকে জানান, আমার বিরুদ্ধে একটি মহল অপপ্রচার করছে। দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে আমি চাকরি থেকে ইস্তফা দিবো।
মিটারিং ডিভিশনের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আলামিনের (আইডি-২১৫২৫) চাকরির শুরুটা হয়েছিলো ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট। চাকরিতে যোগদান করেই ট্রেনিং শেষে প্রথম পদায়ন পান মিটারিং ডিভিশনে। এরপর তার আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। একই জায়গায় ৯ বছর পদায়নে থেকে অনিয়ম আর দুর্নীতি করে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
মিটারিং ডিভিশনের পদায়ন পেয়ে তিনি যেন হাতে পান আলাদিনের চেরাগ! একই জায়গায় প্রায় ৯ বছর চাকরি করে গড়ে তুলেছে দুর্নীতির সিন্ডিকেট। আলামিন ডিপিডিসির সেন্ট্রালের আওতাধীন বনশ্রী, বাসাবো, নারিন্দা, মতিঝিল, মুগদা ও স্বামীবাগ এলাকায় উচ্চচাপ সংযোগকারীদের সংযোগ চালু করেন। আর এই সংযোগ চালু করার সূত্র ধরেই ছয়টি ডিভিশনে আলামিন আবার গড়ে তুলেছে একটি সিন্ডিকেট। সূত্র জানায়, আলামিনের স্থানীয় দালাল চক্রে রয়েছে শাহাদাত, করিম, মিলন, রাজ্জাক, হেলাল, মাসুদ করিম, শাহজাহান, ফয়েজসহ আরও বেশ কয়েকজন। গ্রাহকদের উচ্চচাপ বিদ্যুৎসংযোগ চালু করতে গেলেই আলামিনের পক্ষে এই দালাল চক্রই গ্রাহকেদর কাছ থেকে টাকা উঠায়। জানা যায়, এই প্রকৌশলী উচ্চচাপ সংযোগ চালু করতে ১২থেকে ১৫হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে থাকেন। আর এই টাকা না দিলে গ্রাহককে নানান ভোগান্তিতে ফেলা হয়। সূত্র জানায়, আলামিন নামে ও বেনামে রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছেন।
ডিপিডিসির মিটারিং ডিভিশনের গত দুই বছরের উচ্চচাপ সংযোগের নথি ঘেঁটে দেখা যায়- আকরাম হোসেন, আব্দুর রশিদ, সিদ্দিকুর রহমান, ফয়েজ করিম, সিরাজুল ইসলাম, মাহামুদ বিশ্বাস, রায়হান, ইকবাল, শাকিল, তাহের মিয়াসহ উচ্চচাপ সংযোগগুলো চালু করতে গিয়ে এই আলামিন চক্র গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বড় অঙ্কের টাকা। এদের মধ্যে বনশ্রী ও মতিঝিলের দুই গ্রাহকের কাছ থেকে মিটার খারাপ বলে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করলে মুঠোফোনে বাংলাস্কুপকে আলামিন জানান, এখানে চাকরি করে অনিয়মের কোন সুযোগ নেই। দুর্নীতি করার তো প্রশ্নই আসে না। তিনি আরও দাবি করেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই আমি এখানে রয়েছি। আপনার কোন কথা থাকলে পরিচালক প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। মিটারিং ডিভিশনের মাফিয়া চক্রের আরেক সদস্য উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন (আইডি-২১৯৮১)। তিনি চাকরি শুরু করেন ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। চাকরিতে যোগদান করেই তিনি এক মাসের মধ্যে বদলি নেন মিটারিং ডিভিশনে। নতুন কর্মস্থলে যোগ দেন ২০১৯ সালের ১৩মার্চ। এরপর তাকেও আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বদলি হয়েই তিনি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মূলত আরিফ ডিপিডিসির সেন্ট্রালের উচ্চচাপ সংযোগগুলো দেখেন। তাঁরও রয়েছে স্থানীয় নেটওয়ার্ক। স্থানীয় পর্যায়ে তার চক্রের সদস্য বাহার ও মিলন। সংযোগ চালু করতে গিয়ে টাকা না পেলে হরহামেশাই তিনি গ্রাহকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে থাকেন। তাঁর বিরুদ্ধেও ডিপিডিসিতে রয়েছে অভিযোগ। কিন্তু কোনও অভিযোগই সংস্থাটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমলে নেননি। প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকটি সূত্র বলছে, মিটারিংয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির খতিয়ান এবং বেশ কয়েকবার গ্রাহকদের লিখিত অভিযোগের পরও রহস্যজনক কারণে ডিপিডিসির মানবসম্পদ বিভাগ (এইচআর) তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ একটাই, এই চক্রের কাছেও মানবসম্পদ বিভাগের কর্তাব্যক্তিরাও 'ম্যানেজড'!
অভিযোগ সম্পর্কে প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেনকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্য চেয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠালে তিনি সাড়াও দেননি।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) সোনামনি চাকমাকে মিটারিংয়ের বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীর অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে গ্রাহক হয়রানি, কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির প্রতিবেদন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু কিছু প্রতিবেদনের সত্যতাও আমরা পেয়েছিলাম। আমরা দায়ীদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া ও প্রকৌশলীদের অন্যত্র পদায়নের উদ্যোগও নিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান তখন আমাদের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে মৌখিকভাবে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারছি না।
সোনামনি চাকমা আরো বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ যদি এখন আমাদের নির্দেশনা দেয়, তবে বিধি মোতাবেক অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে ডিপিডিসির এইচআর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলেছে, সম্প্রতি অবসরে যাওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) গোলাম মোস্তফার ছত্রছায়ায় দিনের পর দিন মিটারিংয়ে দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানি হয়েছিলো। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার এটিও একটি কারণ। মিটারিং ডিভিশনের সিন্ডিকেট চক্রটি এতোটাই শক্তিশালী যে, এইচআর কর্তৃপক্ষকেও তারা 'ম্যানেজ' করে রেখেছে। গ্রাহক কোন অভিযোগ করলেও অভিযোগপত্রটিই গায়েব হয়ে যেত।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বাংলাস্কুপকে বলেন, কোন কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানি, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে রয়েছে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ডিপিডিসির অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের কোনও বিধিনিষেধ নেই। দোষ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অবশ্যই চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলা স্কুপ/বিশেষ প্রতিবেদক/এসকে
ডিপিডিসি সূত্র জানায়, মূলত মিটারিং বিভাগে বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী গ্রাহক হয়রানি, দুর্নীতির মাধ্যমে থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও কালো টাকার মালিক হয়েছেন। তাই বদলির শঙ্কা দেখা দিলেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তা বাতিল করে দেন তাঁরা।
মিটারিং ডিভিশনের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, মূলত ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুনিম ইসলাম, সাব-ডিভিশনাল (এসডি) প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী, সহকারী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ আলামিন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেনসহ আরও কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছেন মিটারিং ডিভিশনের সিন্ডিকেট। বছরের পর বছর একই জায়গায় পদায়ন থেকে গড়ে তুলেছেন রাজধানীজুড়ে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কারণে গ্রাহক হয়রানি চরমে পৌঁছেছে। গ্রাহকের আঙ্গিনায় উচ্চচাপ মিটার সংযোগ চালু করতে গিয়ে গ্রাহকের কেনা ক্যাবল একটু নয়ছয় থাকলেই তারা গ্রাহককে চেপে ধরে টাকা দেয়ার জন্য। না হলে সংযোগ চালু করে না। এ যাবতীয় গ্রাহকের কাছ থেকে তারা ২৫ থেকে ৩০হাজার টাকা টাকা আদায় করে থাকে। উচ্চচাপ গ্রাহকদের মিটার সংযোগ করতে গিয়ে উৎকোচ না পেলেই এই চক্র নানান ফন্দি-ফিকির করে সংযোগ আটকে দেয়। অসহায় গ্রাহক তখন বাধ্য হয়েই তাদের উৎকোচ দেয়।
মিটারিং বিভাগের দক্ষিণের দায়িত্বে রয়েছেন সাব-ডিভিশনাল প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী (আইডি২১৫৮৩)। তাঁর চাকরি জীবনের ৯ বছরের ৮ বছরই তিনি কাজ করছেন এখানে। অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ডিপিডিসির মিটারিং বিভাগে অনিয়মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গড়ে তুলেছেন একচ্ছত্র আধিপত্য। তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডিপিডিসির সবচেয়ে লোভনীয় জায়গা হলো নারায়ণগঞ্জ বেল্ট। কেননা, এই এলাকার বেশিরভাগ গ্রাহকই শিল্পপ্রতিষ্ঠান। পলাশের অধীনে থাকা উপসহকারী প্রকৌশলী সিব্বির ও আবুল হোসেনের মাধ্যমে সে যত অনিয়ম করে অর্থ কামাচ্ছে। সূত্র আরও জানায়, নারায়ণগঞ্জ বেল্টে পলাশের সিন্ডিকেটে রয়েছে স্থানীয় দালাল কবির, মালেক, মিজান ও বাহার। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই পলাশ কৃষ্ণ টাকা কামাচ্ছেন। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই সিন্ডিকেটের অন্যায় আবদারে তাঁরা অতিষ্ঠ। তাঁরা আরও অভিযোগ করেন, এদের বিষয়ে ডিপিডিসির প্রধান কার্যালয়ে লিখিতভাবে জানানো হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরীকে এ বিষয়ে মুঠোফোনে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি কোন দুর্নীতি করি না। আমার নাম ব্যবহার করে আমার অধীনে থাকা প্রকৌশলীরা যদি মাঠপর্যায়ে কোন অনিয়ম-দুর্নীতি করে, তার দায় তো আমার না।
মিটারিং ডিভিশনের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, মিটারিং চক্রের আরেক সদস্য সহকারী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন দুর্নীতি করে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে তিনি বাংলাস্কুপকে জানান, আমার বিরুদ্ধে একটি মহল অপপ্রচার করছে। দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে আমি চাকরি থেকে ইস্তফা দিবো।
মিটারিং ডিভিশনের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আলামিনের (আইডি-২১৫২৫) চাকরির শুরুটা হয়েছিলো ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট। চাকরিতে যোগদান করেই ট্রেনিং শেষে প্রথম পদায়ন পান মিটারিং ডিভিশনে। এরপর তার আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। একই জায়গায় ৯ বছর পদায়নে থেকে অনিয়ম আর দুর্নীতি করে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
মিটারিং ডিভিশনের পদায়ন পেয়ে তিনি যেন হাতে পান আলাদিনের চেরাগ! একই জায়গায় প্রায় ৯ বছর চাকরি করে গড়ে তুলেছে দুর্নীতির সিন্ডিকেট। আলামিন ডিপিডিসির সেন্ট্রালের আওতাধীন বনশ্রী, বাসাবো, নারিন্দা, মতিঝিল, মুগদা ও স্বামীবাগ এলাকায় উচ্চচাপ সংযোগকারীদের সংযোগ চালু করেন। আর এই সংযোগ চালু করার সূত্র ধরেই ছয়টি ডিভিশনে আলামিন আবার গড়ে তুলেছে একটি সিন্ডিকেট। সূত্র জানায়, আলামিনের স্থানীয় দালাল চক্রে রয়েছে শাহাদাত, করিম, মিলন, রাজ্জাক, হেলাল, মাসুদ করিম, শাহজাহান, ফয়েজসহ আরও বেশ কয়েকজন। গ্রাহকদের উচ্চচাপ বিদ্যুৎসংযোগ চালু করতে গেলেই আলামিনের পক্ষে এই দালাল চক্রই গ্রাহকেদর কাছ থেকে টাকা উঠায়। জানা যায়, এই প্রকৌশলী উচ্চচাপ সংযোগ চালু করতে ১২থেকে ১৫হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে থাকেন। আর এই টাকা না দিলে গ্রাহককে নানান ভোগান্তিতে ফেলা হয়। সূত্র জানায়, আলামিন নামে ও বেনামে রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছেন।
ডিপিডিসির মিটারিং ডিভিশনের গত দুই বছরের উচ্চচাপ সংযোগের নথি ঘেঁটে দেখা যায়- আকরাম হোসেন, আব্দুর রশিদ, সিদ্দিকুর রহমান, ফয়েজ করিম, সিরাজুল ইসলাম, মাহামুদ বিশ্বাস, রায়হান, ইকবাল, শাকিল, তাহের মিয়াসহ উচ্চচাপ সংযোগগুলো চালু করতে গিয়ে এই আলামিন চক্র গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বড় অঙ্কের টাকা। এদের মধ্যে বনশ্রী ও মতিঝিলের দুই গ্রাহকের কাছ থেকে মিটার খারাপ বলে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করলে মুঠোফোনে বাংলাস্কুপকে আলামিন জানান, এখানে চাকরি করে অনিয়মের কোন সুযোগ নেই। দুর্নীতি করার তো প্রশ্নই আসে না। তিনি আরও দাবি করেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই আমি এখানে রয়েছি। আপনার কোন কথা থাকলে পরিচালক প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। মিটারিং ডিভিশনের মাফিয়া চক্রের আরেক সদস্য উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন (আইডি-২১৯৮১)। তিনি চাকরি শুরু করেন ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। চাকরিতে যোগদান করেই তিনি এক মাসের মধ্যে বদলি নেন মিটারিং ডিভিশনে। নতুন কর্মস্থলে যোগ দেন ২০১৯ সালের ১৩মার্চ। এরপর তাকেও আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বদলি হয়েই তিনি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মূলত আরিফ ডিপিডিসির সেন্ট্রালের উচ্চচাপ সংযোগগুলো দেখেন। তাঁরও রয়েছে স্থানীয় নেটওয়ার্ক। স্থানীয় পর্যায়ে তার চক্রের সদস্য বাহার ও মিলন। সংযোগ চালু করতে গিয়ে টাকা না পেলে হরহামেশাই তিনি গ্রাহকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে থাকেন। তাঁর বিরুদ্ধেও ডিপিডিসিতে রয়েছে অভিযোগ। কিন্তু কোনও অভিযোগই সংস্থাটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমলে নেননি। প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকটি সূত্র বলছে, মিটারিংয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির খতিয়ান এবং বেশ কয়েকবার গ্রাহকদের লিখিত অভিযোগের পরও রহস্যজনক কারণে ডিপিডিসির মানবসম্পদ বিভাগ (এইচআর) তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ একটাই, এই চক্রের কাছেও মানবসম্পদ বিভাগের কর্তাব্যক্তিরাও 'ম্যানেজড'!
অভিযোগ সম্পর্কে প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেনকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্য চেয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠালে তিনি সাড়াও দেননি।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) সোনামনি চাকমাকে মিটারিংয়ের বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীর অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে গ্রাহক হয়রানি, কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির প্রতিবেদন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু কিছু প্রতিবেদনের সত্যতাও আমরা পেয়েছিলাম। আমরা দায়ীদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া ও প্রকৌশলীদের অন্যত্র পদায়নের উদ্যোগও নিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান তখন আমাদের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে মৌখিকভাবে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারছি না।
সোনামনি চাকমা আরো বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ যদি এখন আমাদের নির্দেশনা দেয়, তবে বিধি মোতাবেক অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে ডিপিডিসির এইচআর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলেছে, সম্প্রতি অবসরে যাওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) গোলাম মোস্তফার ছত্রছায়ায় দিনের পর দিন মিটারিংয়ে দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানি হয়েছিলো। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার এটিও একটি কারণ। মিটারিং ডিভিশনের সিন্ডিকেট চক্রটি এতোটাই শক্তিশালী যে, এইচআর কর্তৃপক্ষকেও তারা 'ম্যানেজ' করে রেখেছে। গ্রাহক কোন অভিযোগ করলেও অভিযোগপত্রটিই গায়েব হয়ে যেত।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বাংলাস্কুপকে বলেন, কোন কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানি, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে রয়েছে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ডিপিডিসির অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের কোনও বিধিনিষেধ নেই। দোষ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অবশ্যই চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলা স্কুপ/বিশেষ প্রতিবেদক/এসকে