মাছ, পাট ও সবজিসহ নানা ফসল পরিবহন সহজ হয়েছে

এক সড়কে চাঙ্গা ১০ গ্রামের অর্থনীতি

আপলোড সময় : ১৯-০৬-২০২৫ ০১:৫৭:১২ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ১৯-০৬-২০২৫ ০২:৩৫:৫০ অপরাহ্ন
আধুনিক সড়কে বদলে গেছে পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার অন্তত ১০ গ্রামের অর্থনীতির চিত্র। কৃষি প্রধান এ অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনে স্বস্তি ফিরেছে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের মনে। সহজেই উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগাযোগ সহজ হওয়ায় কমেছে অপরাধ প্রবণতা।

এলজিইডি ও স্থানীয় সূত্র বলছে, আটঘরিয়া উপজেলার দেবোত্তর-একদন্ত সড়কের পুস্তিগাছা থেকে একদন্ত বাজার পর্যন্ত গ্রামীণ সড়কটি দীর্ঘদিন সরু ও খানাখন্দে ভরা থাকায় ভোগান্তির শেষ ছিল না। পুকুরে মাছ ও কৃষি পণ্য পরিবহনে বড় গাড়ির প্রয়োজন হলেও সড়কটি অত্যন্ত সরু হওয়ায় ঢুকতো না বড় গাড়ি। এমনকি রোগী পরিবহনে অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হতো কয়েকটি অঞ্চলের মানুষ। এছাড়া এ সড়কটি দিয়ে কয়েকটি উপজেলার মানুষের আন্তঃজেলা ও ঢাকাগামী মূল মহাসড়কে সংক্ষিপ্ত পথে যাতায়াতের সুবিধা থাকলেও অপ্রশস্ত সংকীর্ণ ভাঙাচোরা পথে তার সুফল মিলতো না। দুর্গম এলাকা হওয়ায় ছিল নিরাপত্তা সংকটও। মাঝে মাঝেই চরমপন্থি সন্ত্রাসী ও ডাকাত দলের আক্রমণের শিকার হতেন পথচারীরা।

তবে এখন মিলেছে এসব সমস্যার সমাধান। সম্প্রতি দেবোত্তর থেকে আটঘরিয়া পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির (ডব্লিউএমম) দীর্ঘ ৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ করেছে পাবনা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এতে করে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগাযোগ সহজ হওয়ায় কমেছে অপরাধ প্রবণতা। বেড়েছে অর্থনৈতিক গতি। স্থানীয়রা জানান, এই অঞ্চলের পুস্তিগাছা, কয়রাবাড়ি, ডেঙারগ্রাম, যাত্রাপুর ও শিবপুর সহ সব গ্রামগুলোই কৃষিনির্ভর। এ অঞ্চলের মাঠে মাঠে মৌসুমভেদে সোনালি আশ পাট, ধান, পেঁয়াজ ও রসুনসহ বিভিন্ন সবজি আবাদ হয়। আছে মৎস্য উৎপাদনকারী অসংখ্য বাণিজ্যিক পুকুরও। আগে এই সড়কটি পাকা থাকলেও অত্যন্ত সরু হওয়ায় ট্রাকসহ বড় বড় গাড়িগুলো ঢুকতে পারতো না। ফলে উৎপাদিত ফসল ও পণ্য বাজারে নেয়ার জটিলতায় ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হতেন তারা।

স্থানীয় বাসিন্দা আরশেদ বলেন, পুকুরে মাছ চাষে আটঘরিয়ার একটা সুনাম আছে। এখানকার মাছ বিভিন্ন জায়গায় যায়। এছাড়া শাক-সবজিও ব্যাপক চাষ হয়। কিন্তু রাস্তা ভালো না থাকায় এগুলো দূরের বাজারে নেওয়া কঠিন ছিল। আবার এরইমধ্যে কয়েকটি গ্রামে ছোট-বড় বিভিন্ন রকমের কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলোর পরিসর বৃদ্ধিতেও ভালো সড়কের খুব প্রয়োজন হয়ে ওঠে। এসময় এই সড়কটি হওয়ায় খুবই উপকৃত হচ্ছেন স্থানীয়সহ সবাই।

কয়রাবাড়ি গ্রামের আলম ও সাইদুল ইসলাম বলেন, এই সড়কের দু’পাশ দিয়ে শুধু আবাদি জমি। এগুলোতে এখন পাটের চাষ হয়েছে। যখন পাট তোলা হয় তখন চাষিদের খুব ভোগান্তি পোহাতে হতো। গাড়ি ঢুকতো না, মাথায় করে পরিবহনের জন্য অতিরিক্ত লেবার লাগতো। এতে করে খরচ বাড়তো। আবার ভালো দাম পেতে শহর বা দূরের অন্যান্য বাজারে নেওয়া যেত না। মুনাফালোভী ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করতে হতো। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় তারাও দাম কম দিতো। এতে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হতাম আমরা। শুধু পাট নয়, বিভিন্ন মৌসুমে শাকসবজি বা অন্যান্য যেকোনো ফসলের ক্ষেত্রেই একই ভাগ্য ছিল আমাদের। কিন্তু পুরো রাস্তার কাজ শেষ না হলেও এরইমধ্যে বড় ট্রাকে বিভিন্ন পণ্য একবারে দূরদূরান্তের বাজারে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। এতে পরিবহন খরচ কমার পাশাপাশি ভালো দামও মিলতে শুরু করেছে।

সুত্রার বিলের কৃষক হানিফ বলেন, আশপাশের গ্রামগুলোতে বিভিন্ন সবজি ও মাছের আবাদ হয়। কিন্তু সরু ও ভাঙা রাস্তায় এগুলো বাজারে নেওয়া নিয়ে খুব সমস্যা ছিল। এবার সেটি থাকবে না। একদম জমির পাশে গাড়ি দাঁড়াবে, সহজেই মালামাল বাজারে নিয়ে ভালো দাম পাওয়া যাবে। পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা ও পথচারী লিটন মন্ডল বলেন, রোগী নিয়ে আগে জেলা শহরের হাসপাতালে যাওয়ায় খুব ভোগান্তি ছিল, বড় অ্যাম্বুলেন্স ঢোকাই কঠিন ছিল। এখন এসব সমস্যা থাকবে না। সড়কটি অনেক চওড়া হয়েছে। একইসঙ্গে গ্রামে বিভিন্ন ছোট ছোট গার্মেন্টস ও কুটির শিল্পের কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। ফলে কর্মসংস্থান বেড়েছে।তিনি বলেন, এই সড়ক পাবনা শহর, আটঘরিয়া শহর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর একে অপরের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করেছে। ট্রাক, বাস-মিনিবাস বা অন্যান্য যানবাহনে অনায়াসে ওইসব অঞ্চলে চলাচল করা যাবে। আগে পুলিশের গাড়িও সচরাচর না ঢোকায় নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা ঘটতো।

আটঘরিয়া থানার ওসি শফিকুজ্জামান সরকার বলেন, একসময় ডেঙারগ্রাম, যাত্রাপুর, শিবপুর এলাকাগুলোতে চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ছিল। চাঁদাবাজি, হত্যা, ডাকাতি ছিল নিয়মিত ঘটনা। এখন তা নেই। প্রশস্ত উন্নত সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্রুত পৌঁছানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কৃষি সমৃদ্ধ গ্রামগুলোতে পেশাদার অপরাধীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই আধুনিক সড়কটি ডাব্লিউ এমএম পদ্ধতিতে নির্মাণ হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে বালি, খোয়া ও পানি দিয়ে ১০-১২ দিন মিশ্রণের মাধ্যমে রাস্তায় ফেলে রোলারের মাধ্যমে কম্পেকশন করা হয়েছে। ফলে অতীতে চুন সুড়কির মাধ্যমে ইমারত নির্মাণের মত শক্ত হচ্ছে রাস্তাগুলো। সড়ক প্রশস্ত করে আঠারো ফুট করা হয়েছে। বর্তমান প্রযুক্তিতে নির্মিত রাস্তা পূর্বের তুলনায় ৫০ ভাগ আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাবে। রাস্তাটি প্রশস্ত করার কারণে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে। এছাড়া পূর্বে ২৫ মিলিমিটার কার্পেটিং করা হতো বর্তমানে সেটা ৪০ মিলিমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে এলজিইডির আটঘরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী মো. বাকীবিল্লাহ বলেন, শিডিউল মোতাবেক রাস্তাটির গভীরতা ৬ ইঞ্চি থাকলেও গড়ে অর্ধ ইঞ্চি বেশি হয়েছে। বর্তমানে রাস্তাটি ৪০ মিলিমিটার কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সড়কটির মাধ্যমে এই অঞ্চলে আরও বড় পরিবর্তন আসবে। কাজটি আমরা নিয়মিত তদারকি করছি।

এলজিইডি পাবনা জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলেন, এই রাস্তাটি একদম নতুন ও আধুনিক পদ্ধতিতে করা হয়েছে। ফলে সাধারণ পদ্ধতির রাস্তার তুলনায় নির্মাণ ব্যয় অল্পকিছু বেশি হলেও এর স্থায়িত্ব কয়েকগুণ বেশি। সহজে নষ্ট হবে না। ফলে বার বার সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে সরকারি অর্থ অপচয় কমের পাশাপাশি যাতায়াতকারীদের জন্য স্বস্তির একটি জায়গা হয়েছে। তিনি বলেন, আটঘরিয়ার ওই অঞ্চলগুলোতে মাছ, পাট ও সবজিসহ নানা ফসল আবাদ হয়ে থাকে। এগুলো মূলত কৃষি প্রধান এলাকা। আবার বেশকিছু কল-কারখানাও রয়েছে। আরও গড়ে উঠছে। এ সংশ্লিষ্ট পণ্য পরিবহনে হেভি লোডেড গাড়িগুলো চলাচলের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ও শিল্পভিত্তিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে তারা খুব সহজেই এই সড়ক দিয়ে তাদের পণ্য আনা নেওয়া করতে পারবে। এতে করে এই অঞ্চলে কৃষি ও শিল্পভিত্তিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা বেড়েই যাচ্ছে।

বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এনআইএন

সম্পাদক ও প্রকাশক :

মোঃ কামাল হোসেন

অফিস :

অফিস : ৬/২২, ইস্টার্ণ প্লাাজা (৬ তলা), কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স, হাতিরপুল, ঢাকা।

ইমেইল :