বহাল তবিয়তে দুর্নীতিবাজরা, বিদ্যুৎ উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা

আপলোড সময় : ২০-০৫-২০২৫ ১২:০২:৫১ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ২০-০৫-২০২৫ ০১:৪৭:১৫ অপরাহ্ন
বহাল তবিয়তে রয়েছেন বিগত স্বৈরাচার সরকারের মদদপুষ্ট বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের তালিকা করে তাদের অপসারণ ও শাস্তির দাবি জানালেও জোরালো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিদেশে পাচার করা অর্থ দ্রুত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবিও পূরণ হয়নি। 

বিতরণী কোম্পানিগুলোর প্রকৌশলীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট, টাকা পাচার, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য থেকে শুরু করে হেন কোন অপকর্ম নেই - যা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা করেনি। এতো কিছু করার পরও স্বৈরাচার সরকারের এই দোসররা কীভাবে এখনও স্বপদে বহাল রয়েছেন, সে প্রশ্ন উঠেছে। এরা এখন ভোল পাল্টে  নীতি-আদর্শের বুলি কপচাচ্ছেন। থেমে নেই তাদের দুর্নীতিও। দ্রুত এদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নিলে সৎ প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে ভুল বার্তা পৌছাবে। প্রকৌশলীরা এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ উপদেষ্টার জোরালো হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) দুর্নীতিগ্রস্ত বোর্ড পরিচালক এবং কর্মকর্তাদের অপসারণ ও শাস্তির দাবি জানিয়ে একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে নাম উল্লেখ করে বলা হয়, এসব কর্মকর্তা বদলি-নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যসহ অনিয়ম ও শত শত কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাটের সাথে জড়িত। যার ফলে বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি ডিপিডিসি প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা আর্থিক লোকসান গুনছে। বিগত স্বৈরশাসকের আমলে গত সাড়ে ১৫ বছরে দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের নামে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যথেষ্ট তথ্য সম্বলিত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। উল্লিখিত দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা বিগত স্বৈরাচার সরকারের মদদপুষ্ট হয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, যা বর্তমান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং শহীদদের সাথে চরম প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

চিঠিতে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয় তাদের অন্যতম হলেন- নির্বাহী পরিচালক (এইচআর) সোনামণি চাকমা, নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) মো. গোলাম মোস্তফা, জিটুজি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাজিবুল হাদী ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) নিহার রঞ্জন সরকার, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য  ও ডেসকোর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাওসার আমির আলী, সাবেক কোম্পানি সচিব আসাদুজ্জামান, প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো.  জাহাঙ্গীর আলম এবং বনশ্রী ডিভিশনের সিনিয়র সহকারী হিসাবরক্ষক মো. জসিমউদ্দিন।

এদের মধ্যে নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) মো. গোলাম মোস্তফা ও প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো.  জাহাঙ্গীর আলম অবসরে গিয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য  ও ডেসকোর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাওসার আমির আলী বর্তমানে পর্ষদে নেই। সাবেক কোম্পানি সচিব আসাদুজ্জামান এখন আর ডিপিডিসিতে নেই। বাকিরা রয়েছেন বহাল তবিয়তে।

ডিপিডিসি সূত্র বলছে, সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন নির্বাহী পরিচালক, প্রকৌশলী ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। সূত্রের দাবি, নির্বাহী পরিচালক (এইচআর) সোনামণি চাকমা এখনও স্বপদে বহাল থাকায় তাঁর দুর্নীতিও থেমে নেই। প্রকৌশলী থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকর্মী - কে কোথায় বদলি হবে, দক্ষিণার বিনিময়ে তা নির্ধারণ করে থাকেন তিনি। লেনদেনে কারো সঙ্গে বনিবনা না হলে তার উপর নেমে আসে চাকরিবিধির খড়গ। 

অন্যদিকে, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পিজিসিবি’র সাবেক প্রকল্প পরিচালক কিউ এম শফিকুল ইসলাম বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমানের আশির্বাদে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) পদে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। যোগদান করেই তিনি গড়ে তোলেন দুর্নীতির এক বড় সিন্ডিকেট। দুর্নীতিবাজদের তালিকার প্রথমদিকে নাম থাকার পরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে সূত্রের দাবি।

এর আগে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ডেসকোর দুর্নীতিবাজদের তালিকা সংবলিত একটি চিঠি উপদেষ্টার কাছে পাঠায় বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ। সেখানে ডেসকোর নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল, নির্বাহী পরিচালক (সংগ্রহ) এ কে এম মহিউদ্দীন, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান স্বাধীনসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হয়। এরা সবাই সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর মদদপুষ্ট বলে চিঠিতে বলা হয়। ডেসকোর প্রকৌশলীরা জানান, এই চিঠির প্রেক্ষিতে জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল ও  এ কে এম মহিউদ্দীনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আর বাড়ানো হয়নি। তবে এখনও স্বপদে বহাল রয়েছেন হাফিজুর রহমান স্বাধীনসহ অন্য দুর্নীতিবাজরা।

গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এপিএসসিএল) তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। তাঁরা হলেন সংস্থাটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান ভূঞা ও মো: কবির হোসেন এবং নির্বাহী পরিচালক (পরিচালন ও সংরক্ষণ) প্রকৌশলী মো. আব্দুল মজিদ। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ দুর্নীতিবাজদের তালিকা দেওয়ায় এই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। এপিএসসিএল সূত্র জানায়, ওই তিন কর্মকর্তাও এখন বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সোমবার (১৯ মে) রাতে বাংলা স্কুপকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদের চিঠি আমি দেখেছি। ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বেশ কিছু বিতরণী কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ডিপিডিসি ও নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ইতিমধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। ডেসকোর দুই নির্বাহী পরিচালকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বর্ধিত করা হয়নি। ইতিমধ্যে ডিপিডিসির আইসিটি ও অর্থ বিভাগে নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ওজোপাডিকো ও পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন্স) কিউ এম শফিকুল ইসলামের নিয়োগপ্রক্রিয়া, তাঁর দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া শুরু হয়েছে। 

বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদের করা দুর্নীতিবাজদের তালিকা নিয়ে দুদক কাজ করছে বলেও জানান উপদেষ্টা।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (এইচআর) সোনামণি চাকমার অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমের রিপোর্ট দেখেছি। যেহেতু তিনি একজন আমলা, তাই তাঁর বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কথা বলব। অনিয়ম-দুর্নীতি করলে কেউ ছাড় পাবে না।

বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, বিগত স্বৈরাচার সরকার বিদ্যুৎ খাতের মত জনগুরুত্বপূর্ণ খাত নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলা করেছে। সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কবলে পড়ে বিপর্যস্ত হয়েছিল এই খাত।  ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ খাতকে পুনর্গঠনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও হয়েছে, যার সুফল পাচ্ছে দেশবাসী। এই অগ্রযাত্রায় বিতরণী কোম্পানির কোনো কর্মকর্তা-প্রকৌশলীর বিন্দুমাত্র অসততার প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/এসকে

সম্পাদক ও প্রকাশক :

মোঃ কামাল হোসেন

অফিস :

অফিস : ৬/২২, ইস্টার্ণ প্লাাজা (৬ তলা), কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স, হাতিরপুল, ঢাকা।

ইমেইল :