​বিদ্যুৎচুরি

বার বার ধান খেয়ে যায় 'ঘুঘু'!

আপলোড সময় : ১৭-০৫-২০২৫ ০৫:৪৬:০৩ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ২০-০৫-২০২৫ ০১:৪৮:৫২ অপরাহ্ন
রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। প্রতিষ্ঠানটির ডিভিশনগুলোতে বাৎসরিক ঠিকাদারের বিদ্যুৎকর্মীদের দৌরাত্ম্য, গ্রাহক হয়রানি ও বিদ্যুৎচুরির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। কোনো কোনো জায়গায় প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা থাকায় বিদ্যুৎচুরি ঠেকাতে পারছে না ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ। আবার প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তখন 'ম্যানেজ' করে ফেলেন তদন্তদলকে। আর তখনই তদন্ত কমিটি দায়সারা প্রতিবেদন দাখিল করে। মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে বিদ্যুৎচুরি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের অন্য জায়গায় বদলি করে। সততার সঙ্গে দায়িত্বপালন করা প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা বলছেন, অসৎ লোকদের সংখ্যা একেবারেই কম। কিন্তু অনিয়ম ও দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাওয়ায় তারা হয়ে ওঠে বেপরোয়া। এতে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি বার বার প্রশ্নের মুখে পড়ছে।

দুর্নীতি করে বার বার পার পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠা এমনই এক কর্মকর্তা ডিপিডিসির শীতলক্ষ্যা ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোরশেদ। তাঁর দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কাছে জিম্মি ওই ডিভিশনের সাধারণ বিদ্যুৎগ্রাহক। সম্প্রতি শীতলক্ষ্যা ডিভিশনের আওতাধীন ফতুল্লার মুসলিমনগর এলাকার বাসিন্দা হাজী মো. মহসিনের (কাস্টমার নং ৩৬০৯৩২১৯) বাড়িতে ডিপিডিসির টাস্কফোর্স বৈদ্যুতিক মিটার বাইপাসের (মিটারে সংযোগ না দিয়ে) ঘটনা শনাক্ত করে। পরবর্তীতে ওই টাস্কফোর্স মিটারটি জব্দ করে। এসংক্রান্ত নথি বাংলা স্কুপের হাতে এসেছে। 

বিষয়টির খোঁজ নিতে গিয়ে গোলাম মোরশেদের দুর্নীতির চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। বাংলা স্কুপের তথ্যানুসন্ধান বলছে, এ পর্যন্ত যতগুলো ডিভিশনে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন, প্রতিটি কর্মস্থলেই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো না কোনো অভিযোগ ছিল। জানা যায়, বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে গিয়ে ঘুষগ্রহণ, মিটার টেম্পারিং, সার্ভারে গ্রাহকের রিডিং কম দেখানো, মিটারের বাইরে দিয়ে চুক্তিতে বিদ্যুৎ ব্যবহার, বিদ্যুৎ বিলের কিস্তি করার সময় ঘুষগ্রহণসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ উঠলেও ডিপিডিসির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে 'ম্যানেজ' করেই বার বার পার পেয়ে যান তিনি। আর এভাবেই এই কর্মকর্তা নামে-বেনামে অনেক সম্পদের মালিক বনে গেছেন। আওয়ামী লীগ শাসনামলের সুবিধাভোগী গোলাম মোরশেদ রাতারাতি ভোল পাল্টে বিএনপির নেতৃত্বাধীন প্রকৌশলীদের সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন। এরই প্রভাব খাটিয়ে শীতলক্ষ্যা ডিভিশনে গড়ে তুলেছেন একটি চক্র। তবে ডিপিডিসির বিএনপিপন্থী প্রকৌশলীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের দাবি, নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলামের সঙ্গে বিশেষ সখ্যের কারণে কেউই মোরশেদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলতে পারে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাস্কফোর্সের এক সদস্য জানান, বিদ্যুৎচুরির সঙ্গে ডিভিশনের বিদ্যুৎকর্মী ও কোন না কোন প্রকৌশলী জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে ওই গ্রাহককে জরিমানার আওতায় আনা হবে।

জানা গেছে, ওই ডিভিশনের বাৎসরিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মুন্সি ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুৎকর্মী মো. মনির হোসেন ওই বিদ্যুৎগ্রাহক হাজী মো. মহসিনের বাড়ির বিল করতেন। ওই বাড়িতে বিদ্যুৎচুরি হচ্ছে জানতে পেরে তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করে ডিপিডিসির টাস্কফোর্স। নিয়ম অনুযায়ী, বাড়ির মিটার জব্দ করে মিটার রিডার মনির হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন টাস্কোফোর্সের সদস্যরা। আর তখনই বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। ওই মিটার রিডার টাস্কফোর্সকে জানান, তার নামে কাগজেকলমেই ওই এলাকার বিদ্যুৎ বিল করার কথা রয়েছে। কিন্তু ওই এলাকায় বিল করছেন আরেক বিদ্যুৎকর্মী কাইয়ুম। বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে মনির হোসেন বলেন, শীতলক্ষ্যা ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোরশেদ তাঁর পরিবর্তে কাইয়ুমকে দিয়ে বিল করান। আর তাঁকে দিয়ে অফিসে কম্পিউটারে অনলাইনের দাপ্তরিক কাজ করান। মনির হোসেন আরো জানান, আমার নামে বিলবই থাকলেও বিল করছেন আরেকজন। তাদের চুরির দায় আমি কেন নিব?

মনির হোসেন বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত সোমবার টাস্কফোর্স ওই গ্রাহকের চারতলা ভবনে অভিযান চালায়। সাতটি মিটারের মধ্যে একটি মিটারে বাইপাস পায় টাস্কফোর্সের সদস্যরা। পরবর্তীতে বাড়ির লাইনটি বিচ্ছিন্ন করে গ্রাহকের মিটারটি জব্দ করে আমাদেরকে (বাড়ি মালিক ও আমি) মঙ্গলবার বিদ্যুৎভবনের টাস্কফোর্স দপ্তরে আসতে বলা হয়। পরবর্তীতে ওইদিন টাস্কফোর্স সদস্যরা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আমি যা সত্য তাই তাঁদেরকে বলেছি। নির্বাহী প্রকৌশলীর নির্দেশে বাস্তবে আমি বিল করি না, বিল করে কাইয়ুম- এই কথাটি টাস্কফোর্স সদস্যরা কোনো অবস্থাতেই মানতে নারাজ। যতটুকু শুনেছি, ওই বাড়ির গ্রাহক বিদ্যুৎচুরির দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। 

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মনির হোসেন বলেন, কোনো প্রকৌশলীর যোগসাজশ ছাড়া কোনো গ্রাহক বিদ্যুৎচুরি বা বাইপাস করতে পারে না। ওই গ্রাহকের সঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামানের কী সখ্য আছে, তা আপনি বুঝে নেন। মনির হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি ২০১৫ সাল থেকে এই ডিভিশনে সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসছি। নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে গ্রাহকের বিশেষ সম্পর্কের দায় আমি কেন নিব? আমি তো কোনো চুরি করিনি। ডিভিশনের প্রধানের নির্দেশনা মেনেই আমি অফিসে কাজ করি।

বিদ্যুৎচুরির বিষয়ে খোঁজ নিতে বৃহস্পতিবার (১৫ মে) বিদ্যুৎকর্মী কাইয়ুমকে মুঠোফোনে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী স্যারই ভালো বলতে পারবেন। আর বিল বইটি তো আমার নামে নয়। আপনি আমাকে কেন প্রশ্ন করছেন? কাইয়ুম আরো বলেন, যতদূর জানি ওই গ্রাহক প্রতিমাসেই নির্বাহী প্রকৌশলী স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। আমি ছোট চাকরি করি- তাঁদের মধ্যে কী হয়, তা আমি আপনাকে বলতে পারব না। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে এই বিদ্যুৎকর্মী বলেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা হেড অফিস ম্যানেজ করেই সবকিছু করে থাকেন। আপনার নিউজে কীইবা হবে? যদি চান, তাহলে আমি গোলাম মোরশেদ স্যারের সঙ্গে কথা বলে 'কিছু একটা' ব্যবস্থা করে আপনার অফিসে এসে দেখা করব।

ফতুল্লা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শের আলী জানান, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। যেহেতু টাস্কফোর্স চুরিটি ধরেছে, গ্রাহককে কী পরিমাণ টাকা জরিমানা করা হবে তা তারাই নির্ধারণ করবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী কোনো অবস্থাতে একজন বিদ্যুৎকর্মীর নামে ইস্যুকৃত বিলবই অন্যজনকে দিতে পারেন না। তবে প্রয়োজন হলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমোদনক্রমে দাপ্তরিক আদেশের মাধ্যমে তা করতে পারে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বৃহস্পতিবার (১৫ মে) ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ. এম. শফিকুল ইসলাম এবং শীতলক্ষ্যা ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোরশেদকে একাধিক ফোন করা হলে তাঁরা সাড়া দেননি।

ডিপিডিসির কোম্পানি সচিব ও টাস্কফোর্সের প্রধান কে এম সালাহউদ্দিন বৃহস্পতিবার (১৫ মে) বিকেলে বাংলা স্কুপকে বলেন, কোনো অবস্থাতে ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী একজনের নামে ইস্যকৃত বিলবই অন্যজনকে দিতে পারেন না। যদি এটা করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তিনি চাকরির বিধিমোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যার নামে বিলবই ইস্যু করা রয়েছে, বিদ্যুৎচুরির দায় তার উপরেই বর্তাবে। অফিস আদেশের বাইরে বিদ্যুৎকর্মী কাইয়ুমকে দিয়ে কেন বিল করানো হবে, তা রীতিমত রহস্যজনক। এটা প্রমাণিত হলে চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী ওই নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

টাস্কফোর্সের প্রধান আরো বলেন, আমাদের লোকবল সীমিত। তারপরও টাস্কফোর্সের সদস্যরা ডিভিশনগুলোতে তাদের গোয়েন্দা নজরদারি রাখছেন। কোনো একটা ঘটনা জানতে পারলেই আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিই। আমি  অসাধু গ্রাহকদের অনুরোধ করব, বিদ্যুৎচুরি বন্ধ করুন। নইলে জরিমানার পাশাপাশি বিদ্যুৎ আইন মোতাবেক জেলও হতে পারে।

এদিকে, ডিপিডিসির প্রকৌশলীরা বলছেন, নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোরশেদ যতগুলো ডিভিশনেই চাকরি করেছেন, তার নামে কোনো না কোনো গুরুতর অভিযোগ ছিল। চলতি বছরে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় গণমাধ্যমে গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশ করে শীতলক্ষ্যা ডিভিশনের কর্মকর্তাদের বিদ্যুৎচুরি নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। পরবর্তীতে দুর্নীতি দমন কমিশন ওই ডিভিশনসহ এলাকায় অভিযানও চালিয়েছিল। কিন্তু গোলাম মোরশেদসহ অন্য এক প্রকৌশলী পার পেয়ে যান। শীতলক্ষ্যায় আসার আগে মাতুয়াইল ডিভিশনের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এক গ্রাহকের কাছ থেকে সংযোগের কথা বলে তার ২৫ লক্ষ টাকা ঘুষ নেয়ার কথা ব্যাপক আলোচনায় এসেছিল।

(আগামীকাল থাকছে দ্বিতীয় পর্ব)

বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/এসকে

সম্পাদক ও প্রকাশক :

মোঃ কামাল হোসেন

অফিস :

অফিস : ৬/২২, ইস্টার্ণ প্লাাজা (৬ তলা), কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স, হাতিরপুল, ঢাকা।

ইমেইল :