
চর্বিজাতীয় পদার্থ জমা হতে হতে রক্তনালীর মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার পথকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বন্ধ (ব্লক) করে দেয়াকেই হার্টে ব্লক বলা হয়ে থাকে। হার্ট ব্লক সাধারণত জন্মগতভাবে কম দেখা যায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়। এটিকে অ্যাট্রিওভেন্ট্রিকুলার (এভি) ব্লক বা কন্ডাকশন ডিসঅর্ডার নামেও ডাকা হয়।
বর্তমান সময়ে অনেকেই হার্ট ব্লকের সমস্যায় ভোগেন। একবার এই সমস্যা হলে বাইপাস কিংবা রিং ছাড়া সমাধান নেই। তবে অনেকেই বুঝতে পারেন না হার্ট ব্লক হয়েছে, যার ফলে হঠাৎ অসুস্থ হতে হয়। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের এক প্রতিবেদনে চিকিৎসকরা হার্ট ব্লক বা হার্ট ব্লকেজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে।
হার্ট ব্লক কী
হার্ট ব্লক হলো হৃৎপিণ্ডের সংকেত প্রবাহে একটি সমস্যা। এতে হৃৎপিণ্ডের উপরের অংশ (অ্যাট্রিয়া) থেকে নিচের অংশে (ভেন্ট্রিকল) বিদ্যুৎ সংকেত সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারে না। সাধারণত, এই সংকেতগুলো অ্যাট্রিয়া থেকে ভেন্ট্রিকলে যায় এবং এটি এভি নোড নামক কোষের একটি গুচ্ছের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। হার্ট ব্লকের ক্ষেত্রে, এই সংকেত কখনো কখনো পৌঁছায়, আবার কখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। এটি হৃৎস্পন্দনকে ধীর বা অনিয়মিত করে তুলতে পারে।
জটিল অবস্থায়, হার্ট ব্লক রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয়, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রভাব ফেলে। হার্ট ব্লক সাধারণত জন্মগতভাবে কম দেখা যায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়। এটিকে অ্যাট্রিওভেন্ট্রিকুলার (এভি) ব্লক বা কন্ডাকশন ডিসঅর্ডার নামেও ডাকা হয়।
হার্ট ব্লকের প্রকারভেদ
হার্ট ব্লকের তীব্রতা নির্ভর করে সংকেত কতটা পৌঁছাচ্ছে এবং কত ঘন ঘন পৌঁছাচ্ছে তার ওপর। হার্ট ব্লকের প্রকারগুলো হলো:
প্রথম-ডিগ্রি হার্ট ব্লক: এটি সবচেয়ে হালকা ধরনের হার্ট ব্লক। এখানে সংকেত ভেন্ট্রিকলে পৌঁছায়, তবে এভি নোডের মাধ্যমে স্বাভাবিকের চেয়ে ধীরগতিতে।
দ্বিতীয়-ডিগ্রি হার্ট ব্লক: এখানে সংকেত মাঝে মাঝে ভেন্ট্রিকলে পৌঁছায়। এটি দুটি উপ-প্রকারে বিভক্ত:
টাইপ ১: সংকেত ধীরে ধীরে পৌঁছায় এবং মাঝে মাঝে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়। এটি তুলনামূলকভাবে কম গুরুতর।
টাইপ ২: কিছু সংকেত পৌঁছায় না, ফলে হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত ও ধীর হয়। এটি গুরুতর এবং প্রায়ই পেসমেকারের প্রয়োজন হয়।
তৃতীয়-ডিগ্রি হার্ট ব্লক: এটি সম্পূর্ণ ব্লক, যেখানে অ্যাট্রিয়া থেকে ভেন্ট্রিকলে কোনো সংকেত পৌঁছায় না। এটি হৃৎপিণ্ডের রক্ত পাম্প করার ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে এবং সাধারণত পেসমেকারের প্রয়োজন হয়।
লক্ষণ
হার্ট ব্লকের লক্ষণ নির্ভর করে এটি কতটা গুরুতর এবং হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতায় কীভাবে প্রভাব ফেলছে তার ওপর। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
১. হৃদপিণ্ডে বেশি পরিমাণে ব্লক থাকলে বুকে ব্যথা হয়। আস্তে আস্তে ব্যথা বাম হাতে ছড়িয়ে পড়ে। হাঁটার সময়, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় বুকে ব্যথা হয়, থামলে ব্যথা কমে যায়।
২. দম নিতে ও ছাড়তে কষ্ট হয়।
৩. বুকে জ্বালাপোড়া ও ধড়ফড় করে।
৪. গলা, কপাল ও মাথায় ঘাম হওয়া।
৫. নিচের দিকে হেলে কিছু করার ও একটু ভারী কিছু বহনের সময় কষ্ট হয়।
৬. খাবার হজম না হওয়ার মতো অস্বস্তি লাগে। বমি বমি ভাব।
৭. সবসময় ক্লান্তিভাব।
৮. হৃদস্পন্দনের অনিয়ম।
৯. মাথা ঘোরা।
১০. অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
প্রথম-ডিগ্রি হার্ট ব্লকের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে এবং এটি প্রায়ই রুটিন ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি) পরীক্ষার সময় ধরা পড়ে। তৃতীয়-ডিগ্রি হার্ট ব্লকের লক্ষণগুলো ধীর হৃদস্পন্দনের কারণে বেশি তীব্র হয়। গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন।
হার্ট ব্লকের কারণ
রক্তনালীতে চর্বিজাতীয় বস্তু খুব ধীরে ধীরে জমা হতে থাকে। তাই হার্ট ব্লক খুবই ধীরগতিতে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। যেমন ধরুন একটি ব্লক ১০% থেকে বৃদ্ধি পেতে পেতে ৮০%-এ পৌঁছাতে ব্যক্তিভেদে ১০ থেকে ৩০/৪০ বছর সময় লাগতে পারে। তাই বলা হয়ে থাকে, ব্যক্তি হার্ট ব্লক নিয়ে দীর্ঘসময় সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
হার্ট ব্লকের সংখ্যা এবং পারসেন্টেজ একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় না পৌঁছানো পর্যন্ত রোগী কোনোরূপ শারীরিক অসুস্থতা বোধ করেন না। হার্ট ব্লকের কারণে রোগীর হার্টের রক্ত সরবরাহের স্বল্পতা দেখা দেয়। হার্ট ব্লকের (%) পার্সেন্টেজ বৃদ্ধি পেলে ব্লকের ভাটির দিকের অংশে রক্ত সরবরাহ কমে যায়।
ফলশ্রুতিতে প্রাথমিক পর্যায়ে পরিশ্রম বা টেনশনকালীন সময়ে রক্ত সরবরাহের ঘাটতি দেখা দেয়ায় এ সময়ে রোগী বুকে চাপ, ব্যথা, বুক ধড়ফড় বা সহজে হয়রান বা পেরেশান হয়ে পড়েন। তবে দিনে দিনে রোগী ঘনঘন এসব অসুবিধায় পতিত হয়ে থাকেন। এভাবে বেশ কিছু বছর চলে যেতে পারে। দিনে দিনে ব্লকের তীব্রতা (পার্সেন্টেজ) বৃদ্ধি পেয়ে অসুস্থতাকে আরও জটিল করে তোলে। হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট স্ট্রোক এক ধরনের মারাত্মক অসুস্থতা।
যার ফলশ্রুতিতে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে এবং চিকিৎসা খুবই দ্রুততার সঙ্গে নিতে হয়। প্রায় সময়ই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। বহুবিধ কারণে হার্ট ব্লকের চর্বিজাতীয় বস্তুতে রক্তক্ষরণ ঘটতে পারে। তাতে প্রদাহ দেখা দিতে পারে অথবা চর্বি জাতীয় বস্তুর ওপর রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালীতে রক্তপ্রবাহ সম্পূর্ণরূপে বা মারাত্মক পর্যায়ে বন্ধ করে দিতে পারে।
হার্ট ব্লকের ঝুঁকিতে যারা
আপনার হার্ট ব্লকের ঝুঁকি বাড়তে পারে যদি:
১. আপনার করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা হৃৎপিণ্ডের ভালভের রোগ থাকে।
২. জন্ম থেকেই হৃদপিণ্ডে অস্বাভাবিকতা থাকে।
৩. রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ বা সারকয়েডোসিসের মতো রোগ থাকে।
৪. ভেগাস নার্ভ অতিরিক্ত সক্রিয় থাকে, যা হৃৎস্পন্দন ধীর করে।
৫. আপনি এমন ওষুধ সেবন করেন যা হৃৎপিণ্ডের সংকেতকে ধীর করে দেয়।
প্রতিরোধের উপায়
কিছু ক্ষেত্রে হার্ট ব্লক প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন:
১. হার্ট সুস্থ রাখার জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনধারা মেনে চলা।
২. সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম, ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকা।
৩. উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
৪. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ওষুধ পরিবর্তন বা পর্যালোচনা করা।
৫. বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট হলে তা উদ্বেগের কারণ হতে পারে। তবে হার্ট ব্লক নির্ণয়ের মাধ্যমে এই লক্ষণগুলোর কারণ বোঝা যায়।
সুসংবাদ হলো, চিকিৎসার মাধ্যমে, যেমন ওষুধ বা পেসমেকার, হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখা সম্ভব। আপনার চিকিৎসা পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনো কিছু পরিষ্কার না হলে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করুন।
বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এসকে