বিবিসি বাংলা প্রতিবেদন
আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে শেষ পর্যন্ত কেমন হলো চারুকলার শোভাযাত্রা?
ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় :
১৪-০৪-২০২৫ ০৬:৪০:৫০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৪-০৪-২০২৫ ০৬:৪০:৫০ অপরাহ্ন
সংবাদচিত্র : ফোকাস বাংলা নিউজ
নাম পরিবর্তন, প্রতিকৃতি নিয়ে বিতর্কসহ নানান আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম মূল অনুষঙ্গ চারুকলার শোভাযাত্রা।
আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে বের হওয়া র্যালিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবছর বের হয় 'বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা' নামে। এতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নেচে গেয়ে বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেন হাজারো মানুষ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও র্যালিতে অংশ নিতে আসা সাধারণ মানুষের মধ্যে শুরুতে নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। তবে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়াই ঘণ্টাব্যাপী শোভাযাত্রাটি শেষ হয়।
জুলাই গণ অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশটিতে এবারই প্রথম পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হচ্ছে। ফলে শোভাযাত্রার আয়োজনেও সেটির প্রতিফলন ছিল চোখে পড়ার মতো। এবছর শোভাযাত্রায় প্রতিপাদ্য ছিল 'নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান'।
র্যালিতে ব্যবহৃত প্রধান আটটি প্রতিকৃতির মধ্যে তিনটিই ছিল গণঅভ্যুত্থান কেন্দ্রিক। এর মধ্যে র্যালির একেবারে সামনের দিকে ছিল বহুল আলোচিত 'ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি' নামের প্রতিকৃতিটি।
শনিবার ভোররাতে আগুন দিয়ে এই মোটিফটি পুড়িয়ে দেওয়ার পর গত দু'দিনে সেটি পুনরায় তৈরি করা হয়।
এই প্রতিকৃতির মাধ্যমে মূলত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার শাসনামলে ঘটা অন্যায়-অবিচার ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কেউ কেউ এর সমালোচনা করে অভিযোগ তুলেছেন যে, বৈশাখের শোভাযাত্রাকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে।
যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অর্ন্তবর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা।
এদিকে, বাঙালিদের পাশাপাশি ২৮টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা এবার চারুকলার শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। নববর্ষ উপলক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে তাদেরকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় আনা হয়।
কতটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল?
চারুকলার শোভাযাত্রায় অংশ নিতে সোমবার ভোর থেকেই ঢাকা ও এর আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে শুরু করে।
সোমবার সকাল নয়টায় শোভাযাত্রা শুরু হওয়ার আগে হাজারো মানুষ চারুকলা অনুষদের সামনের রাস্তায় একত্রিত হন। এবারের আয়োজনে যারা অংশ নেন, তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশই ছিল বয়সে তরুণ।
"আমি আগে কখনো আসিনি, তবে টিভিতে দেখেছি। এবার ফেন্ডরা (বন্ধুরা) সবাই মিলে এসেছি। খুব ভালো লাগছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তাসনিম শ্রেয়া।
একই কথা বলছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী কায়সার আহমেদ, যিনি গত জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন।
"স্বৈরাচার হাসিনা যেভাবে এদেশের মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে, সেটার প্রতিবাদে আমি এরকম সব আয়োজন বর্জন করেছিলাম। প্রায় দশ বছর পর এবার মুক্ত-স্বাধীন পরিবেশে আবারও আসলাম," বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. আহমেদ।
তবে প্রতিবছরই শোভাযাত্রায় অংশ নেন, এমন অনেকেও ছিলেন।
"আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী ছিলাম। ফলে সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে, মানে প্রায় এক যুগ ধরে নিয়মিতভাবেই এই আয়োজনে অংশ নিয়ে আসছি বলা চলে," বলছিলেন শামসুন্নাহার মুক্তা।
অতীতের আয়োজনের সঙ্গে এবার কী কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে? প্রশ্ন ছিল মিজ মুক্তার কাছে।
"পার্থক্য তো কিছুটা আছেই। এবার সবখানেই গণ অভ্যুত্থানের ছাপ দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া মানুষের সংখ্যাও আগের তুলনায় কিছুটা কম মনেও হচ্ছে," বলছিলেন মিজ মুক্তা।
একই কথা বলছিলেন শ্যামলী বিশ্বাস নামের আরেক নারী।
"তবে মানুষ কিছুটা কম থাকায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। নাহলে গরমে অবস্থা খারাপ হয়ে যেত," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিজ বিশ্বাস।
শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া অনেকেই জানিয়েছেন যে, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবারের আয়োজন গোছানো ছিল।
"এবার সবকিছু বেশ গোছানো, পরিপাটি। কোনো ধস্তাধস্তি নাই। সেজন্য বেশি ভালো লেগেছে," বলেন রিয়াজুল করিম নামের এক অংশগ্রহণকারী।
তিনি এটাও বলছিলেন যে, র্যালিতে আসার সময় তার মনে নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা শঙ্কা কাজ করছিল।
"কিন্তু এখানে আসার পর দেখলাম প্রচুর পুলিশ। র্যাব আর বিজিবিও রয়েছে। এটা দেখে ভয় কেটে গেছে," বলেন মি. করিম।
সোমবার সকাল নয়টায় শুরু হয়ে শোভাযাত্রাটি প্রথমে শাহবাগ মোড়ে যায়। মোড় ঘুরে টিএসসি'র সামনে দিয়ে শহীদমিনার ও দোয়েল চত্বর হয়ে পুনরায় চারুকলায় ফিরে এসে র্যালি শেষ হয়।
শোভাযাত্রা চলাকালে সামনে-পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য সেটির পাহারায় ছিলেন।
এছাড়া শোভাযাত্রায় বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা নিজ নিজ ঐতিহ্যের পোশাক পরে র্যালিতে অংশ নেন।
"এবার সর্বপ্রথম সংস্কৃতি উপদেষ্টা মহোদয় আমাদেরকে অফিসিয়ালভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, সেজন্য বান্দরবান থেকে আমরা ১২টি জাতিগোষ্ঠী এখানে সমবেত হয়েছি," বিবিসি বাংলাকে বলেন বান্দরবান জেলা উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি চনুমুং।
আগে এ ধরনের আমন্ত্রণ পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, "এখানে আসতে পেরে ভালো লাগছে। বাংলাদেশে মনে হয় এই প্রথম সকলকে নিয়ে বাংলা নববর্ষ পালন হচ্ছে।"
শোভাযাত্রায় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে জার্সি গায়ে অংশ নিতে দেখা যায়।
এছাড়া অন্যবছরের মতো এবারও বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিক র্যালিতে অংশ নেন।
রাজনীতিকরণের অভিযোগ প্রসঙ্গে যা বললেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা
শোভাযাত্রায় অংশ নিতে সোমবার সকাল নয়টার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
এসময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "অনেকদিন ধরে এটাকে আমরা বাঙালির প্রাণের উৎসব বানিয়ে রেখেছি। কিন্তু এটা বাংলাদেশের প্রাণের উৎসব। কারণ বাঙালি, চাকমা, মারমা, গারোসহ সব জাতিগোষ্ঠী বর্ষবরণ পালন করে," বলেন উপদেষ্টা মি. ফারুকী।
শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, "এখানে চাপিয়ে দেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। আগে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নাম ছিল বর্ষবরণ শোভাযাত্রা, যশোরে। সেখান থেকে ঢাকায় আসার পর নাম হয় আনন্দ শোভাযাত্রা।"
"এরপর চাপানো হয় 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'। এবার চারুকলা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, চারুকলায় যে নামে চালু হয়েছিল, সে নামে শুরু হবে," বলেন মি. ফারুকী।
শোভাযাত্রাকে রাজনীতিকরণের যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি অস্বীকার করেছেন উপদেষ্টা। উল্টো অভিযোগ করে বলেন যে, অতীতে শোভাযাত্রাটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
"এই শোভাযাত্রা ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট গ্রুপ তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজে ব্যবহার করেছে। আমরা এবার শুধুমাত্র ফ্যাসিস্টের মুখাবয়ব ব্যবহার করেছি। কারণ ফ্যাসিস্ট কোনো রাজনীতির অংশ না। সে সবচেয়ে বড় অশুভশক্তি।"
কেমন ছিল ছায়ানটের আয়োজন?
চারুকলায় শোভাযাত্রা শুরু আগে, সোমবার ভোরে রাগ ভৈরবীর মাধ্যমে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয়।
রাগ ভৈরবীর পর দলীয় কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীত "এসো হে বৈশাখ, এসো এসো" গান গেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা নতুন বছর ১৪৩২-কে স্বাগত জানান ছায়ানটের শিল্পীরা।
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ, মুক্তচিন্তার নির্ভয় প্রকাশ, আবহমান সংস্কৃতির নির্বিঘ্ন যাত্রা ধারণ করলে মুক্তির আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুগম হবে বলে মন্তব্য করেছেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী।
সোমবার সকালে ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শেষ করার আগে তিনি এ কথা বলেন।
মুক্তির সাধনা বাঙালিকে নিজ দেশেও নানান চড়াই-উতরাই প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে উল্লেখ করেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি বলেন, "নববর্ষের উষালগ্নে, আজ চোখ ফেলি হিসাব-নিকাশের হালখাতায়। একদিকে মুক্তির জন-আকাঙ্ক্ষা অর্জনের প্রত্যাশা, অন্যদিকে পীড়াদায়ক বিদ্বেষ-বিভক্তি, নারী-শিশুর অমানবিক মর্যাদাহানি ও অপরিণামদর্শী অসহিষ্ণুতা। সব অতৃপ্তি প্রতিবিধানের দায় রাষ্ট্রের, তবে সমাজকেও সে দায় নিতে হয় বৈকি।"
"আমরা এক আলোকিত দেশ ও সমাজের স্বপ্ন দেখি, যে দেশের মানুষ সর্বজনের শান্তি-স্বস্তি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ধর্ম-জাতি-বিত্তের বিভাজন ভাঙবে। গড়বে উদার সম্প্রীতির সহিষ্ণু সমাজ," বলেন মি. আলী।
শেষের দিকে গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়ে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অনুষ্ঠান শেষ করা হয়।
প্রতিবছরের মতো এবারও অনেক মানুষ ওই আয়োজন দেখতে রমনা বটমূল প্রাঙ্গণে একত্রিত হয়।
"আমি প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে আসি। অন্য বছরের মতো এবারও আয়োজন ভালো ছিল। তবে ভিড় কিছুটা কম বলে আমার মনে হয়েছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কাজল রেখা নামের এক নারী।
অনুষ্ঠান চলাকাল রমনা পার্ক ও এর আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক র্যাব-পুলিশ-বিজিবি ও সোয়াটের সদস্য মোতায়েন ছিল।
বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স