অর্ধশতাধিক নির্দেশদাতাসহ গ্রেপ্তার দেড় হাজার ॥ ডিএমপির থানাগুলোতে দৈনিক কোটা ১৫ জন
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে চিরুনি অভিযান শুরু
আপলোড সময় :
০৭-১০-২০২৪ ১২:০৫:১১ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৭-১০-২০২৪ ০৬:৫৮:০৩ অপরাহ্ন
প্রতীকী ছবি । সংগৃহীত
বাংলা স্কুপ স্পেশাল :
আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে অঘোষিত চিরুনি অভিযান শুরু করছে পুলিশ। ঢাকাসহ সারাদেশে বাড়িয়েছে গ্রেপ্তার অভিযান। অথচ পুলিশের পক্ষ থেকে এর আগে বলা হয়েছিল, মামলা হলেই কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না। গ্রেপ্তার করার আগে যাচাই-বাছাই করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। বরং গত কয়েক দিনে মামলা ও গ্রেপ্তারের হিড়িক পড়ে গেছে রাজধানীসহ সারা দেশে। একের পর এক গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনাও দেখা দিয়েছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীরা। এমনকি, যারা কোনো ধরনের অপরাধ, দুর্নীতি বা রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না তারাও ভয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছেন। ফলে এসব নেতাকর্মীর পরিবারের সদস্যরা সামাজিক, পারিবারিক এবং আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তবে পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তারের সংখ্যা বাড়লেও ঢালাও গ্রেপ্তারের অভিযোগ ঠিক নয়। প্রাথমিকভাবে পাওয়া অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ফলে যারা কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না তাদের অহেতুক আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, যারা মামলা দিচ্ছে, তারা সাধারণ জনগণ। দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আর বঞ্চনার শিকার হয়ে অনেকে মামলা দিচ্ছেন। মামলা করার অধিকারও সবার আছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা কমে যাবে। তা ছাড়া কেউ অন্যায় করলে তাকে আইনের মোকাবিলা করতেই হবে। তবে তদন্ত ছাড়া অযাচিতভাবে হয়রানির উদ্দেশ্যে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না। পুলিশকে এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দেওয়া আছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, সাবেক মন্ত্রী, এমপি বা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যে মামলা হচ্ছে পুলিশ সদর দপ্তর সেই মামলাগুলো ক্লোজ মনিটরিং করছে। যাদের গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন শুধু তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরপরও তদন্তে যদি দেখা যায়, তাদের বিরুদ্ধে এজাহারে আনা অভিযোগের প্রমাণ নেই, তাহলে চার্জশিট থেকে অবশ্যই তাদের নাম বাদ যাবে। অযথা কেউ হয়রানির শিকার হবেন না। শুধু অপরাধীরাই আইনের হাতে ধরা পড়বে। এ ব্যাপারে মাঠপর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আইজিপি আরও বলেন, সাবেক মন্ত্রী, এমপি বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ অফিসারসহ যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তথ্য ও ভিডিও ক্লিপের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়ে অপরাধীদের ধরা হচ্ছে।
সম্প্রতি পুলিশের গ্রেপ্তার তৎপরতা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে পুলিশের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, এখন যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তারা অধিকাংশই পলাতক ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ গ্রেপ্তারের আগেই কিছুটা মনিটরিং করা হয়েছে। এর জন্য সময় লাগছে। আবার পলাতক থাকার কারণে তাদের সন্ধান পেতেও সময় লেগেছে। অনেকে বাইরের কোনো দেশে যাওয়ার জন্য যখন বের হচ্ছেন তখন তাদের সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এসব কারণেই এখন গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেশি বলে মনে হচ্ছে। এ ছাড়া ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্ত করতেও পুলিশের কিছুটা সময় লেগেছে বা লাগছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশের ট্রমা কাটিয়ে উঠতেও কিছুটা সময় লেগেছে। ধীরে ধীরে তারা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে এসেছে। ঢাকার বাইরের জেলা ও থানা পর্যায়ের পুলিশও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে।
জানা গেছে, গত কয়েক দিনে যুবলীগ-ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রোববার (৬ অক্টোবর) গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, রাজশাহী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খানকে। এর আগে শনিবার (৫ অক্টোবর) গ্রেপ্তার করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব ও জামালপুর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদকে। তার আগে গ্রেপ্তার করা হয় রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়া সচিব মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ। এছাড়াও গ্রেপ্তার হয়েছেন যুবলীগ-ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের থানা-জেলা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের দুই শতাধিক নেতা।
সূত্র জানিয়েছে, গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে পুলিশের আইজিপি-ডিএমপি কমিশনারসহ সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাথে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সার্বিক একটি বৈঠক হয়েছে। যেখানে আওয়ামী লীগের পদধারী বর্তমান ও সাবেক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপরই গ্রেপ্তার অভিযান জোরদার হয়েছে। ডিএমপির একাধিক থানা সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক ১৫ জন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী নেতাদের গ্রেপ্তারে পুলিশ হেড কোয়ার্টার এবং ডিএমপি কার্যালয় থেকে নির্দেশ রয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের এই নির্দেশনা থেকে নড়েচড়ে বসছে সারাদেশের পুলিশ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পুলিশ কার্যত ইন-একটিভ থাকলেও সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযানের মধ্য দিয়ে কিছুটা সচল হয়েছে। আসামি কিংবা সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ধরতে বাসাবাড়ি কিংবা বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার কয়েক দিন পর থেকেই মূলত শুরু হয়েছে মামলা ও গ্রেপ্তারের পালা। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার মামলা হয়েছে। আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, হত্যা, ভাঙচুরসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত জন নির্দেশদাতাসহ প্রায় দেড় হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা সবাই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। এর বাইরেও পেশাদার ও ভাড়াটে সন্ত্রাসী অভিযোগেও অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত এজাহারভুক্ত ৩৯ জন প্রভাবশালীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ডিবির হারুন এবং সাবেক এমপি-মন্ত্রীসহ বাকিদের সন্ধানেও অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস। রোববার (৬ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান তিনি। লে. কর্নেল মুনিম ফেরদৌস বলেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ প্রভাবশালীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিওতে যাদের ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করতে দেখা গেছে তাদের ধরতেও অভিযান চলমান রয়েছে। এসময় কারও কাছে কোনো তথ্য থাকলে তা দিয়ে র্যাবকে সহযোগিতা করার আহবানও জানান তিনি।
এখন পর্যন্ত যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক জ্বালানি খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন ও একেএম শহীদুল হক, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু, সাবেক এমপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, সাবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তর টিভির সিইও মোজাম্মেল বাবু, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা, জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ মাহবুব আরা বেগম গিনি, সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, সাবেক এমপি হাজী সেলিম, আব্দুস সালাম মুর্শেদী, মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী, আব্দুর রউফ ও এমএ লতিফ, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাংগীর আলম প্রমুখ।
এএইচ/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স