ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫ , ২৪ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অন্নপূর্ণা-১ শিখরে বাবর আলী

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ০৭-০৪-২০২৫ ০৪:৩৩:০৩ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৭-০৪-২০২৫ ০৪:৫২:৩৭ অপরাহ্ন
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অন্নপূর্ণা-১ শিখরে বাবর আলী সংবাদচিত্র: সংগৃহীত
পৃথিবীর দশম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ অন্নপূর্ণা-১ এ বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন চট্টগ্রামের বাবর আলী। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ নজির গড়লেন তিনি। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট, লোৎসে ও আমা দাবলামের পর বিপদসংকুল অন্নপূর্ণা-১ এর শীর্ষ ছুঁলেন বাবর। সোমবার (৭ এপ্রিল) ভোরে তিনি চূড়ায় পৌঁছান। গণমাধ্যমকে খবরটি নিশ্চিত করেছেন এই অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান। অভিযানের আউটফিটার মাকালু অ্যাডভেঞ্চারের স্বত্বাধিকারী মোহন লামসালের সূত্রেই এ তথ্য জানা যায়। অন্নপূর্ণা-১ শীর্ষে বাবরের সঙ্গী ছিলেন ক্লাইম্বিং গাইড ফূর্বা অংগেল শেরপা।

বাবরের সংগঠন এবং এই অভিযানের আয়োজক পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের পক্ষ থেকে সোমবার দুপুরে এক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘লাখো শুভাকাঙ্ক্ষীর প্রার্থনার উত্তর দিয়েছেন স্রষ্টা। প্রকৃতিমাতা বিমুখ হননি। বঙ্গ সন্তান বাবরকে ক্ষণিকের জন্য নিজের চূড়ায় দাঁড়াতে দিয়েছে অন্নপূর্ণা। বিশ্বের দশম শীর্ষ পর্বত এবং অন্যতম কঠিন পর্বত ২৬ হাজার ৫৪৫ ফুট উচ্চতার অন্নপূর্ণা-১ এর শীর্ষে প্রথমবার উড়লো আমাদের লাল-সবুজের পতাকা।’পোস্টে আরও বলা হয়, ‘খানিক আগে আউটফিটার কোম্পানির স্বত্বাধিকারী আমাদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া আরও জানা গেছে বাবর আলী সুস্থাবস্থায় ক্যাম্প-৩ এ নেমে এসেছেন। যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়। বাবরকে আজ নেমে আসতে হবে ক্যাম্প-২ এর নিরাপত্তায়। আর আগামীকাল নামতে হবে বেসক্যাম্পে। আর জানেনই তো চড়ার চেয়ে নামা অধিক ঝুঁকির। ওই বিপদসংকুল এলাকায় যোগাযোগ সম্ভব নয়। তাই শীর্ষের ছবি ও ভিডিও প্রাপ্তি আপাতত সম্ভব নয়। বাবরের নিরাপদ অবতরণের জন্য চলুক প্রার্থনা। এরপরই হবে উৎসব।’

বাংলাদেশ থেকে বাবর আলী নেপালে যান ২৪ মার্চ। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ২৬ মার্চ কাঠমান্ডু থেকে প্লেনে উড়ে যান পোখারা। এরপর কিছু পথ গাড়িতে ও বাকি পথ পদব্রজে ২৮ মার্চ পৌঁছে যান বেসক্যাম্পে। অন্নপূর্ণাতে সবকিছুই বেশ দ্রুতলয়ে ঘটে। একদিন বিশ্রাম নিয়েই পরদিন চড়তে শুরু করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে। ক্যাম্প-১ (৫২০০ মিটার) এ দুই রাত এবং ক্যাম্প-২ (৫৭০০ মিটার) এ এক রাত কাটিয়ে ২ এপ্রিল বাবর নেমে আসেন বেসক্যাম্পে। সাধারণত এই সময় শুরু হয় ভালো আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষার পালা। কিন্তু বাবর নেমে এসেই জানতে পারেন আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে ভালো আবহাওয়া থাকবে পরদিন থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত। এদিকে রোপ ফিক্সিং টিম আগেই একবার ফিরে এসেছে ৭৬০০ মিটার উচ্চতা থেকে খারাপ অবস্থার জন্য।

ওই দলের প্রধান ফেসবুক পোস্টে বলেই বসেন, ক্যাম্প-২ থেকে ক্যাম্প-৩ এ যাওয়ার পথের এত খারাপ অবস্থা তিনি আগে কখনোই দেখেননি। তবুও ২ এপ্রিল ওই দল রওয়ানা করে বাকি পথ তৈরি করতে। এই সম্ভাব্য ভালো আবহাওয়া কাজে লাগাতে মাত্র ২৪ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়েই বাবর আবার চড়তে শুরু করেন ৩ এপ্রিল। ওইদিন ক্যাম্প-১ এ থেমে পরদিন উঠে আসেন ক্যাম্প-২। এর মাঝেই শুরু হয় বিপত্তি। বিকেল থেকেই হঠাৎ শুরু হয় তুষারঝড়। দীর্ঘ যোগাযোগহীনতার পর স্বস্তির সুবাতাস জানান দেয় যে ৫ এপ্রিল বাবর পেরিয়ে গেছেন কঠিন অংশ, পৌঁছে গেছেন ক্যাম্প-৩ (৬৫০০ মিটার)। সাধারণত ৭৪০০ মিটার উচ্চতায় ক্যাম্প-৪ তৈরি করে সামিট পুশ শুরু হলেও সিদ্ধান্ত হয় অবস্থার পরপ্রেক্ষিতে এই ক্যাম্প বাদ দিয়ে ক্যাম্প-৩ থেকেই শুরু হবে চূড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা, অর্থাৎ ওই উচ্চতায় একটানা ১৬শ মিটার পথ দিতে হবে পাড়ি।চূড়া পর্যন্ত পথ তৈরি এবং আবহাওয়ার উন্নতির জন্য ক্যাম্প-৩ এ অতিরিক্ত একদিন অপেক্ষা করে ৬ এপ্রিল রাতে ওই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বাবর বেরিয়ে পড়েন।

অভিযান ব্যবস্থাপক ফরহান জামান বলেন, ‘গত বছর এভারেস্ট-লোৎসে সামিটের পর এবার অন্নপূর্ণা-১ শীর্ষে পৌঁছানোর মাধ্যমে বাবর আলী বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছেন। ওর কঠোর পরিশ্রম ও নিরলস অধ্যবসায়ের প্রতিফলন এই সাফল্য। আমরা আশা করি এই অর্জন বাংলাদেশের পর্বতারোহণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।’ বাবরের লক্ষ্য ১৪টি আটহাজারি শৃঙ্গের সবকটিতেই লাল-সবুজের পতাকা উড্ডয়ন বলে জানান তিনি। এই দুঃসাহসিক অভিযানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার্স লি., ভিজ্যুয়াল ইকো স্টাইলওয়্যার লি., এডিএফ এগ্রো, ফ্লাইট এক্সপার্ট, এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লি. এবং ব্লু জে।

নেপালের গন্ডকিতে অবস্থিত অন্নপূর্ণা পর্বত স্থানীয়দের কাছে ফসলের দেবী হিসেবে পূজনীয়। এর মূলত চারটি চূড়া আছে। যার মধ্যে শীর্ষ হলো পৃথিবীর দশম শীর্ষ পর্বত ৮,০৯১ মিটার (২৬,৫৪৫ ফুট) উচ্চতার অন্নপূর্ণা-১। উচ্চতায় দশম হলেও কৌশলগতভাবে অন্যতম কঠিন পর্বত হিসেবে বিবেচিত এই পর্বত একদিকে আছে শীর্ষে। এর সফল সামিটের বিপরীতে মৃত্যুর হার প্রায় ১৪ শতাংশ, যা ২০১২ সাল পর্যন্ত ছিল ৩২ শতাংশ! অর্থাৎ গত মৌসুম পর্যন্ত এই পর্বত সামিট করেছেন ৫১৪ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৭৩ জন। ১৯৫০ সালের ৩ জুন ফ্রান্সের এক দলের মরিস হেরজগ এবং লুইস লেচেনাল এই পর্বত চূড়া প্রথম স্পর্শ করেন, যা যে কোনো আটহাজারি শৃঙ্গে প্রথম মানবসাফল্যও বটে। ওই হিসেবে এ বছরই অন্নপূর্ণা-১ প্রথম সামিটের প্ল্যাটিনাম জুবিলি। অথচ এই ৭৫ বছরের মধ্যে ২০০৯ সালে অন্নপূর্ণা-৪ এ একবার বাংলাদেশি অভিযান হলেও অন্নপূর্ণা-১ এ এটিই প্রথম অভিযান এবং প্রথমবারেই এলো সাফল্য।

বাবর আলী নিজেই চট্টগ্রাম ভিত্তিক দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান সাধারণ সম্পাদক। পেশায় চিকিৎসক এই পর্বতারোহী ২০২৪ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে একই অভিযানে দুটি আটহাজারি শৃঙ্গ এভারেস্ট ও লোৎসে পর্বত এবং প্রথম বাঙালি হিসেবে ২০২২ সালে অন্যতম টেকনিক্যাল চূড়া আমা দাবলাম শীর্ষ স্পর্শের নজির গড়েন। অনেক ছয় হাজারি পর্বত বাদেও বাবর প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ভারতের দীর্ঘতম সড়ক কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী করেছেন সাইক্লিং, প্রথম বাঙালি হিসেবে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার এমাথা থেকে ওমাথা। প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে বার্তা ছড়াতে তিনি ৬৪ দিনে হেঁটেছেন বাংলাদেশের ৬৪ জেলা। এছাড়া লেখক হিসেবে আছে বাবর আলীর বেশ সুখ্যাতি। তিনি ম্যালরি ও এভারেস্ট, পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা, সাইকেলের সওয়ারি, এভারেস্ট ও লোৎসে শিখরে নামক চারটি বইয়ের রচয়িতা। বাবর চট্টগ্রামের হাটহাজারি উপজেলার নজুমিয়া হাটের লেয়াকত আলী এবং লুৎফুন্নাহার বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।

বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন
 


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ