ঢাকা , বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫ , ১৮ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংরক্ষণ নিয়ে বিপাকে কৃষক

আলুর কেজি ১০ টাকা

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ২৮-০৩-২০২৫ ০২:০৭:৫৬ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২৮-০৩-২০২৫ ০২:০৭:৫৬ অপরাহ্ন
আলুর কেজি ১০ টাকা ফাইল ছবি
দিনাজপুরে এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। এতে হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে দাম শুনে সেই হাসি মলিন হয়ে যাচ্ছে। জেলার খুচরা বাজারে বর্তমানে ১৩-১৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও কৃষকরা পাচ্ছেন ৯-১০ টাকা। এ অবস্থায় আলু সংরক্ষণ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।

কৃষকরা বলছেন, বাম্পার ফলন হলেও বাজারে দাম নেই। লোকসান পুষিয়ে উঠতে হিমাগারে রাখতে চাচ্ছেন। কিন্তু সেখানেও জায়গা নেই। দীর্ঘ লাইন দিয়ে আলু রাখতে কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে তাদের। এরপরও জেলায় যে পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে তার ১১ দশমিক ৪২ শতাংশ সংরক্ষণ করা যাবে। বাকি প্রায় ৮৯ দশমিক বাইরে রাখতে হচ্ছে। এতে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়বেন তারা।সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলায় আলু তোলার কাজ শেষের দিকে। দাম না পাওয়ায় হিমাগারে রাখতে এনেছেন কৃষকরা। দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের পাশের হিমাগারটিতে রাখতে ট্রাক, ভ্যান ও ট্রাক্টরসহ বিভিন্ন যানবাহনে আলু নিয়ে আসছেন। হিমাগারের সামনে গাড়ির দীর্ঘ সারি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্যমতে, জেলায় হিমাগার আছে ১৬টি। এর মধ্যে ১৪টি পুরোনো। এবার নতুন করে দুটি স্থাপিত হয়েছে। আগের ১৪টিতে ধারণক্ষমতা এক লাখ ২৭ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। নতুন দুটিতে রাখা যাবে ২০-২২ হাজার টন। অর্থাৎ ১৬টি হিমাগারে আলু রাখা যাবে সর্বোচ্চ এক লাখ ৫০ হাজার টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে জেলায় ৫৭ হাজার ২৩৬ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। এতে উৎপাদন হবে অন্তত ১৩ লাখ ১৪ হাজার ৩২ মেট্রিক টন। কিন্তু সংরক্ষণের জন্য ১৬টি হিমাগারে রাখা যাবে এক লাখ ৫০ হাজার টন। এই হিসাবে প্রায় ১২ লাখ টন আলু কৃষকরা বাড়িতে সংরক্ষণ বা বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘চলতি বছর ৪৭ হাজার ২৩৬ হেক্টর জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে কৃষকরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার হেক্টর অতিরি‌ক্ত জমিতে আবাদ করেছেন। ফলে ৫৭ হাজার ২৩৬ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। এই জমি থেকে অন্তত ১৩ লাখ ১৪ হাজার ৩২ মেট্রিক টন উৎপাদন হবে বলে আশা করা যায়।’এদিকে, বিপুল পরিমাণ আলু বিক্রি করায় কমে গেছে দাম। বর্তমানে ৯-১০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করতে হয়। সদরের ঘুঘুডাঙ্গা এলাকার কৃষক মোসাদ্দেক আলী বলেন, ‘প্রচুর ফলন হয়েছে। কিন্তু ক্ষেত থেকে ৯-১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে সংরক্ষণ করতে হয়েছে। এরপরও যে পরিমাণ সংরক্ষণ করতে চেয়েছি, সেই পরিমাণ রাখতে পারিনি। এতে বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হবে।’

একই এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত চার দিন ধরে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে স্লিপ নিয়ে তারপর হিমাগারে আলু রাখতে পেরেছি। মাঠ থেকে আলু নিয়ে হিমাগারে যেতে নানা ভোগান্তি তো আছেই। গাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্টরা বলেন হিমাগারে জায়গা নাই। এজন্য অনেক কৃষককে ফিরে দিয়েছেন তারা।’বিরল উপজেলার মাঝাডাঙ্গা এলাকার কৃষক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘হিমাগারে রাখতে আগাম বুকিং দিয়ে স্লিপ নিয়েছি। আমরা তিন কৃষক ৮০ বস্তা রাখতে পেরেছি। আমাদের রাখার উদ্দেশ্য হলো, এখন বাজারে দাম নেই। এই আলু বীজ হিসেবে আগামীতে রোপণ করবো। তবে সংরক্ষণের জন্য আরও হিমাগার দরকার। আমি যে পরিমাণ জমি আবাদ করি আমার অন্তত ৫০ বস্তা আলু রাখা উচিত। কিন্তু রাখতে পারলাম ৩০ বস্তা। বাকিগুলো সব বাইরে। এগুলো বিক্রি করে দিতে হবে। কারণ পচে যাবে।’সদরের বোলতৈড় এলাকার কৃষক সেলিম রেজা বলেন, ‘অনেক কৃষক হিমাগারে আলু রাখতে পারছেন না। তবে ব্যবসায়ীরা রাখতে পারছেন। হিমাগার মালিকরা কৃষকদের প্রাধান্য না দিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবে, আর কৃষকরা সবদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দায়িত্বশীলদের বিষয়টি দেখা উচিত।’

এ বিষয়ে দিনাজপুরের মের্সাস জাহানারা কোল্ড স্টোরেজের হিসাবরক্ষক নুর উল্লাহ বলেন, ‘এবার আলু আবাদ বেশি হওয়ায় জেলার সব কোল্ড স্টোরেজে চাপ বেশি। আগে এমন চাপ ছিল না। এর মূল কারণ বাজারে দাম কম। কৃষকরা লোকসানের হাত থেকে বাঁচতে সংরক্ষণ করতে চাচ্ছেন। গত বছর দাম বেশি ছিল। এজন্য এবার কৃষকরা বেশি পরিমাণ জমিতে আবাদ করেছেন। এখনও অধিকাংশ কৃষকের বাড়িতে আলু আছে। অনেকে জমি থেকে তুলছেন। সবমিলিয়ে বেশিরভাগ আলু বাইরে রাখতে হবে। কারণ হিমাগারে জায়গা নেই। ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি উৎপাদন হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’একই কথা বলেছেন পূর্ণভবা কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক মো. সোহান। তিনি বলেন, ‘গতবারের তুলনায় এবার আবাদ বেশি হয়েছে। বাজারে দাম না পেয়ে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে হিমাগারে রাখতে চাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের হিমাগারে যে জায়গা ছিল, তা পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আর রাখার জায়গা নেই। এখন যারাই আলু নিয়ে আসছেন, তাদের আমরা ফেরত পাঠাচ্ছি। কোনও উপায় নেই। বাইরে রাখতে হবে।’

বাইরে থাকা বিপুল পরিমাণ আলু সংরক্ষণের অন্য কোনও ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে দিনাজপুর কৃষি বিপণন অধিদফতরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রবিউল হাসান বলেন, ‘জেলায় গত বছর ১৪টি হিমাগার ছিল। চলতি বছর আরও দুটি স্থাপিত হয়েছে। এগুলোতে মোট ধারণক্ষমতা এক লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। তবে নতুন দুটি স্থাপিত হলেও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি। এজন্য ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ এক লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এবার অতিরিক্ত ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। প্রতি বছর জেলায় ৪৮-৫০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। ১০-১২ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। যে পরিমাণ উৎপাদন হয় তার স্বল্প পরিমাণ সংরক্ষণ করা যায়। ফলে সংরক্ষণ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে। আরও হিমাগার স্থাপন করতে হবে। সেইসঙ্গে সনাতন পদ্ধতিতে সংরক্ষণের জন্য কৃষকদের উদ্যোগ নিতে হবে।’

বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন
 


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ