এক বছর আগে বেইলি রোডের গ্রীন কোজি কটেজে রাত পৌনে ১০টার দিকে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। প্রাণ হারান ৪৬ জন। সেই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। কবে নাগাদ শেষ হবে, বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। ওই ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন নিহতের স্বজনরা।গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লাগে। জীবিত উদ্ধার করা হয় ৭৫ জনকে। মারা যাওয়া ৪৫ জনের মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ১৮ জন নারী ও ৮ জন শিশু।
এ ঘটনায় রমনা মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম মামলা করেন। থানা পুলিশের পর মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এখন পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য ৮ দফা সময় নিয়েছে সংস্থাটি। সর্বশেষ গত ৪ ফেব্রুয়ারি মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ছিল। তবে, ওইদিন সিআইডি প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুজ্জামান আগামী ১১ মার্চ প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।
মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের ইন্সপেক্টর শাহজালাল মুন্সী বলেন, “মামলার তদন্ত চলছে। আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাসখানেক আগে রাজউক ও আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের কাছে আমরা কিছু রিপোর্ট চেয়েছি। উনারা সেগুলো এখনো আমাদের দেননি। কবে নাগাদ দিতে পারবেন সেটাও জানি না। রিপোর্ট না পেলে তদন্ত কাজ আগানো কঠিন। রিপোর্ট পেলেই আরো কিছু কাজ থাকবে, সেগুলো শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।” এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনের সূত্রপাত ইলেকট্রিক কেটলি থেকে। ভবনটির নিচতলার ‘চা চুমুক’ নামে চায়ের দোকানের চা তৈরির জন্য ব্যবহৃত ইলেকট্রিক কেটলি থেকে আগুনের সূত্রপাত। এরপর পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।”
ইতালী প্রবাসী সৈয়দ মোবারক কাউসারসহ একই পরিবারের পাঁচ জন মারা যান ওই অগ্নিকাণ্ডে। পরিবারটির সদস্য আমীর হামজা বলেন, “আমরা সামাজিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা সঠিক বিচার চাই। আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে। আর যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া প্রয়োজন। না হলে, পরবর্তীতে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে।”মামলার আসামিরা হলেন- কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁ মালিক সোহেল সিরাজ, ভবনটির নিচতলার চা-কফির দোকান ‘চুমুক’র দুই মালিক আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান রিমন, বিরিয়ানি রেস্তোরাঁ ‘কাচ্চি ভাই’ বেইলি রোড শাখার কর্মকর্তা জেইন উদ্দিন জিসান, ফুকো চেইন রেস্টুরেন্টের আব্দুল্লাহ আল মতিন, মোহর আলী পলাশ এবং ভবনটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা মুন্সী হাসিবুল আলম বিপুল। তারা সবাই জামিনে আছেন।কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর মালিক সোহেল সিরাজের আইনজীবী তাহসিনা তাবাসসুম তরীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কয়েক দফা ফোন করেও তাকে পাওয়া যাইনি।
ফুকো চেইন রেস্টুরেন্টের আব্দুল্লাহ আল মতিনের আইনজীবী অভিজিৎ কর্মকার বলেন, “তার নাম এজাহারে ছিল না। উনার সঙ্গে কাচ্ছি ভাই রেস্টুরেন্টের কোনো সম্পর্ক নেই। ডিবি পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেও তেমন কিছু পায়নি। তাকে শুধু শুধু মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সঠিক তদন্ত হলে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।”
মামলায় অভিযোগ করা হয়, গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১০টার দিকে ওই ভবনের (গ্রিন কোজি কটেজে) নিচ তলার ‘চুম্বক’ নামীয় রেস্টুরেন্টে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এ কারণে ভবনটিতে আগুন লাগে এবং প্রচণ্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ও ধোঁয়া পুরো ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে থাকা রেস্টুরেন্টে আগত নারী, পুরুষ, শিশু ও অন্যান্য দোকানে আগত ক্রেতা ও ভবনের কর্মরত লোকজনের শোর-চিৎকার, আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচার জন্য আর্তনাদ এবং প্রাণ বাঁচানোর জন্য মানুষের দ্রুত ছোটাছুটি, উৎসুক জনতার কারণে ভবনের অশপাশের এলাকার প্রচুর লোকজনের সমাগম হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পুলিশের বিভিন্ন মোবাইল টিম ও পুলিশ লাইন্স থেকে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়।ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন ও লিফট, ক্রেনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করে ভবনে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যায়।
প্রাথমিকভাবে জানা যায়, ভবনটির স্বত্ত্বধিকারী এবং ম্যানেজার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন ছাড়া কিছু রেস্টুরেন্ট এবং দোকান ভাড়া দেন ভবনটিতে। রেস্টুরেন্টগুলো যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যতিরেকে রান্নার কাজে গ্যাসের সিলিন্ডার এবং চুলা ব্যবহার করে। রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য আসামিসহ ভবন স্বত্ত্বধিকারী এবং ম্যানেজারের যোগসাজসে ‘চুমুক’ ফাস্ট ফুড, কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট, মেজবানী রেস্টুরেন্ট, খানাস ফ্লাগশিপ, স্ট্রিট ওভেন, জেটি, হাক্কা ঢাকা, শেখহলি, ফয়সাল জুসবার (বার্গার), ওয়াফেলবে, তাওয়াজ, পিজ্জাইন, ফোকো, এড্রোশিয়া নামে রেস্টুরেন্ট মালিকরা ভবনটির নিচ তলায় বিপুল পরিমাণে গ্যাস সিলিন্ডার মজুত করে। জন নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে অবহেলা, অসাবধানতা, বেপরোয়া ও বিপদজনকভাবে গ্যাস সিলিন্ডার এবং গ্যাসের চুলা ব্যবহার করে আসছিলেন তারা।
ভবনটির নিচ তলায় থাকা রেস্টুরেন্টের রান্নার কাজে অবহেলা ও অসাবধানতা মূলকভাবে মজুত করে রাখা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয় এবং এই আগুনের তাপ ও প্রচন্ড ধোঁয়া পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে বিভিন্ন ফ্লোরে অবস্থিত রেস্টুরেন্ট ও দোকানে অবস্থানকারী লোকজন আগুনে পুড়ে ও ধোঁয়া শ্বাসনালীতে ঢুকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান এবং গুরুতর আহত হন।
অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন- বুয়েট শিক্ষার্থী নাহিয়ান আমিন, সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রী ওরফে বৃষ্টি খাতুন, ফৌজিয়া আফরিন রিয়া, পপি রায়, আশরাফুল ইসলাম আসিফ, নাজিয়া আক্তার, আরহাম মোস্তফা আহামেদ, নুরুল ইসলাম, শম্পা সাহা, শান্ত হোসেন, মায়শা কবির মাহি, মেহেরা কবির দোলা, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতি তাজরিন নিকিতা, মা ভিকারুন্নিসার নুন স্কুল এন্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা লুৎফুর নাহার করিম, মোহাম্মদ জিহাদ, কামরুল হাসান, দিদারুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান শামীম, মেহেদী হাসান, নুসরাত জাহান শিমু, ইতালী প্রবাসী সৈয়দ মোবারক কাউসার, তার স্ত্রী স্বপ্না আক্তার, ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহ, মেয়ে সৈয়দা ফাতেমা তুজ জোহরা ও সৈয়দা আমেনা আক্তার নুর, জারিন তাসনিম প্রিয়তি, জুয়েল গাজী, রুবি রায়, মেয়ে প্রিয়াংকা রায়, তুষার হাওলাদার, কে এম মিনহাজ উদ্দিন, সাগর, তানজিলা নওরিন, শিপন, আলিসা, সংকল্প সান, লামিশা ইসলাম, অ্যাডিশনাল ডিআইজি নাসিরুল ইসলামের মেয়ে লামিশা ইসলাম ও নাঈম।
বাংলাস্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন