ইউএনবি প্রতিবেদন
‘ডেভিলস ব্রেথ’ বা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ থেকে কীভাবে বাঁচবেন?
ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় :
২৩-০২-২০২৫ ০৮:৩৮:০৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
২৩-০২-২০২৫ ০৮:৪১:১২ অপরাহ্ন
প্রতীকী ছবি: ইউএনবি
রাস্তাঘাটে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের গুরুতর দিক হচ্ছে রাসায়নিক বস্তুর অপব্যবহার। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে মারাত্মক ড্রাগ হলো ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস। এর ভয়াবহ প্রভাবে ভুক্তভোগীরা কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই দুর্বৃত্তদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান এই বিপদ থেকে দূরে থাকার জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরে জনসচেতনতা। চলুন, ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস আসলে কি ধরনের ড্রাগ ও কিভাবে এর থেকে নিরাপদ থাকা যায়- তা বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস কী
নাইটশেড গোত্রভুক্ত উদ্ভিদ (যেমন রাজঘণ্টা, ধুতুরা)-এর পাতা থেকে ট্রোপেন অ্যালকালয়েড নামক এক ধরনের শক্তিশালী জৈব যৌগ পাওয়া যায়। কথিত আছে প্রাকৃতিকভাবে উৎসরিত এই নির্যাসটি মানুষকে জোম্বি বা জিন্দালাশে পরিণত করে। আর তাই উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্কোপোলামিন নামে অভিহিত এই রাসায়নিক বস্তুটি বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে শয়তানের নিঃশ্বাস বা ডেভিলস ব্রেথ নামে।
তবে এমন অদ্ভূত নামের জন্য দায়ী এর অ্যান্টিকোলিনার্জিক বৈশিষ্ট্য। এর ফলে মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর পারস্পরিক বার্তা আদান-প্রদানের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। তাই এটি অতি অল্প মাত্রায় মোশন সিকনেস এবং অত্যধিক বমির চিকিৎসায় ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে পরিমিত মাত্রায় আরোগ্য দানকারী এই ঔষধই অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় বিষ হয়ে ওঠে। এর নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে মস্তিষ্ক বিভ্রম, হ্যালুসিনেশন এবং ঝাপসা দৃষ্টি। এমনকি এর মাত্রাতিরিক্ত সেবনে চরম পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট, হার্ট-অ্যাটাক ও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
স্কোপোলামিনের ব্যাপক অসদ্ব্যবহার দেখা যায় নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। খাবার, পানীয় বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এটি শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তির হ্যালুসিনেশন শুরু হয়। এ সময় মস্তিষ্ক বিভ্রমের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ভুক্তভোগীর স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির বিলুপ্তি ঘটে। যখন বিভ্রান্তি কেটে যায় তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তি কিছুই মনে করতে পারেন না। গন্ধ ও স্বাদ কোনোটাই না থাকায় এই রাসায়নিক পদার্থটি তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করারও উপায় থাকে না।
আর এই সামগ্রিক কারণে চোর ও ছিনতাইকারীদের ভয়ানক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে স্কোপোলামিন। দুষ্কৃতিকারী খাবারে মিশিয়ে অথবা মুখের উপর এর গুঁড়ো ফুঁ দিয়ে জনসাধারণকে আক্রান্ত করে। এছাড়া অনেকে অপরিচিতদের সাহায্য আবেদনে তাদের বাড়িয়ে ধরা কাগজ চোখের কাছে নিয়ে পড়তে যেয়েও ধরাশায়ী হন। এরপর তাকে যা করতে বলা হয় সে কোনো ধরনের দ্বিধা না করে তা অনুসরণ করে। ফলশ্রুতিতে ঘটনাটি আশেপাশের লোকেদের মনেও কোনো সন্দেহের উদ্রেক করে না। এভাবে কোনোরকম বল প্রয়োগ ছাড়াই অসহায় ব্যক্তিটির সর্বস্ব লুটে নেওয়া হয়।
ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস থেকে বাঁচার ১০টি উপায়
অপরিচিতদের দেওয়া খাবার বা পানীয় গ্রহণ না করা
বিভিন্ন গণপরিবহন, যাত্রী ছাউনী, পার্ক, রেস্তোরা ও আবাসিক হোটেল এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এগুলোতে পরিবেশিত কোনো একটি খাবারে মেশানো থাকতে পারে ভয়াবহ স্কোপোলামিন। এসব জায়গা বাদেও যেকোনো অযাচিত খাবারের সুযোগ ভদ্রতার সঙ্গে ফিরিয়ে দেওয়া শ্রেয়। এমনকি অস্বাস্থ্যকর ফেরীওয়ালাদের খাবারও এড়িয়ে চলা উচিত। কেননা সেই বিক্রেতা যেকোনো দুষ্কৃতি চক্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
খাবার বা পানীয় উন্মুক্ত না রাখা
কোথাও খেতে বসে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য কোথাও যাওয়ার সময় খাবার উন্মুক্ত অবস্থায় রাখা উচিত নয়। আশেপাশেই কোথাও ঘাপটি মেরে থাকা কোনো দুর্বৃত্তের জন্য এটি হতে পারে সুবর্ণ সুযোগ। ফিরে এসে হয়ত খাবার সেই আগের স্থানেই পাওয়া যাবে, কিন্তু তা আগের মতো বিশুদ্ধ নাও থাকতে পারে। তাই একা হলে নিজের কেনা বা সঙ্গে করে বহন করা খাবারটি সর্বদা সঙ্গেই রাখতে হবে। সঙ্গী থাকলে তখন কোথাও যেতে হলে খাবার তার দায়িত্বে রেখে যাওয়া যেতে পারে। অবশ্য পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে ভাবলেও তা ঢেকে রেখে যাওয়াটাই উত্তম।
অপরিচিতদের বাড়িয়ে ধরা কাগজ গ্রহণের ব্যাপারে সাবধান
অনেক প্রতারক চক্র আইডি কার্ড, প্রেসক্রিপশন, এমনকি সাদা কাগজে লেখা ঠিকানা জানতে চেয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে। তখন সাহায্য করতে উদ্যত হওয়া ব্যক্তিটি কাগজটি চোখের কাছাকাছি নিতেই ঘটে বিপত্তি। নিঃশ্বাসের সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছে যায় বিপজ্জনক মাত্রার ডেভিলস ব্রেথ। তাই নিজের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ ধরনের অনুরোধগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। নতুনবা একবার এই বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে আশপাশ থেকেও কোনো সাহায্য প্রাপ্তির অবকাশ থাকবে না।
ফুল বিক্রেতাদের ফুলের সুবাস নেওয়া থেকে বিরত থাকা
নিজস্ব কোনো গন্ধ না থাকায় ডেভিলস ব্রেথ অন্যান্য ফুলের সঙ্গে মিশিয়েও শিকারের উপর প্রয়োগ করা যায়। যানজট অথবা পার্কের মতো জায়গাগুলোতে প্রায়ই ফুল বিক্রেতাদের আনাগোণা দেখা যায়। এদের থেকে ফুল কেনার সঙ্গে সঙ্গে তার সুবাস নেওয়া ঠিক নয়। বরং এ ধরনের স্থানগুলোতে এদের এড়িয়ে চলাই উত্তম। বিষয়টি ফুটপাত বা ভ্রাম্যমাণ আতর বা পারফিউম বিক্রেতাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
পথে-ঘাটে চলতে ফিরতে সর্বদা মাস্ক পরিধান করা
করোনা মহামারির সময়ের মতো সার্বক্ষণিক মাস্ক পড়ে চলা কার্যকরী একটি সুরক্ষা পদ্ধতি। পোর্টেবল এয়ার পিউরিফায়ার মাস্ক বায়ুবাহিত যেকোনো টক্সিনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। এই মাস্কগুলোতে থাকা ফিল্টার বাতাসকে পরিশোধিত করে সুস্থ শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তা করে।
সবসময় সঙ্গে পকেট স্যানিটাইজার রাখা
একই সঙ্গে একটি পকেট স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখাটাও অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপত্তির মোকাবেলা করতে পারে। কোভিড-১৯ চলাকালীন সবার মধ্যেই ঘন ঘন হাত স্যানিটাইজের অভ্যাসটি চালু হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে স্কোপোলামিন সংক্রান্ত দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও এই অভ্যাসটির পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন।
কোনো কিছু স্পর্শ করার পর হাত স্যানিটাইজ না করে অন্যান্য কাজ করা যাবে না। যাদের মধ্যে ঘন ঘন নাকে-মুখে হাত দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে তাদের জন্য এই সতর্কতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি অতি গরমের সময় অতিরিক্ত ঘাম মুছার জন্যও মুখমন্ডলে স্পর্শ করার দরকার পড়ে। এ পরিস্থিতিতে একটি পকেট স্যানিটাইজার হতে পারে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কবজ।
টাকা লেনদেনের পর হাত স্যানিটাইজ করা
দৈনন্দিন কাজে ঘন ঘন হাত বদল হওয়ার জন্য টাকা-পয়সা হতে পারে স্কোপোলামিন পরিবহনের সহজ মাধ্যম। তাই লেনদেনের পর সর্বদা হাত ভালভাবে স্যানিটাইজ করে নিতে হবে। বিশেষত জনাকীর্ণ এলাকায় এই সচেতনতা অবলম্বন জরুরি। যাদের মধ্যে জিহ্বে আঙ্গুল দিয়ে টাকা গোণা বা বইয়ের পাতা উল্টানোর প্রবণতা রয়েছে তাদের ডেভিলস ব্রেথে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সর্বাধিক। তাই যেকোনো মূল্যে ঘন ঘন মুখমন্ডল স্পর্শ করার অভ্যাস পরিত্যাগ করা অত্যাবশ্যক।
ব্যক্তিগত জিনিসপত্র অপরিচিতদের নাগালের বাইরে রাখা
কেবল অপরিচিতদের দেওয়া জিনিস গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকলেই হবে না। সেই সাথে খেয়াল রাখতে হবে নিজের জিনিসপত্রও যেন তাদের নাগালের বাইরে থাকে। নিজের কেনা খাবারের সাথে সাথে ব্যাগ, মানিব্যাগ, ও মোবাইল ফোনসহ প্রতিটি জিনিস সযত্নে রাখতে হবে। কোনোভাবেই নিজের নাগালের বাইরে রাখা যাবে না। অন্যথায় এ জাতীয় ছোট ছোট জিনিসপত্রে ক্ষতিকর পদার্থ মেশানোর জন্য কয়েক সেকেন্ডই যথেষ্ট।
বিভিন্ন জায়গা সরবরাহকৃত স্প্রে জাতীয় পণ্য ব্যবহারে সাবধানতা
বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের আবাসিক হোটেলগুলোতে মশা নিরোধক বা এয়ার ফ্রেশনারে সরবরাহ করা হয়। বিশেষ করে মানহীন হোটেলগুলোতে থাকার ক্ষেত্রে এ জাতীয় স্প্রেগুলো ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। ট্যাক্সিতে ওঠার পর গাড়ির দুর্গন্ধ দূর করার জন্য ড্রাইভার এয়ার ফ্রেশনার বের করতে পারে। এর বদলে গাড়ির জানালা খুলে বাতাস চলাচলের পথ তৈরি করে দিতে হবে। এই অতিরিক্ত সাবধানতা ক্ষতিকর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারে।
অ্যাপ-ভিত্তিক পরিবহন সেবাতে অগ্রাধিকার দেওয়া
যাতায়াতে অ্যাপভিত্তিক রাইডগুলোতে আগে থেকেই ড্রাইভারের নাম, ছবি এবং গাড়ির বিশদ বৃত্তান্ত দেখে নেওয়া যায়। পরবর্তীতে সঠিক গাড়িটি যাচাইয়ের জন্য প্লেট নাম্বার মিলিয়ে নেওয়ারও সুযোগ থাকে। এছাড়া অত্যধিক গণপরিবহনের অত্যধিক ভিড়ে ক্ষতিকর স্পর্শের সম্ভাবনা এখানে নেই।
তবে অ্যাপে ড্রাইভার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য ইতিবাচক হওয়ার পরও দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। সেজন্য সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। এ জন্য গাড়িতে ওঠার আগেই পরিচিতিদের সাথে রিয়েল-টাইম লোকেশন শেয়ার করে রাখতে হবে। একা হলে ড্রাইভারের পাশের সিটে না বসে পেছনের সিটে বসতে হবে।
পরিশিষ্ট
ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস মূলত স্কোপোলামাইন নামক একটি রাসায়নিক বস্তু। এটি প্রয়োগের মাধ্যমে মস্তিষ্ক বিভ্রম ঘটিয়ে ভুক্তভোগীর সর্বস্ব লুটে নেয় দুর্বৃত্তরা। এ ধরণের অপরাধমূলক ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য নিজের চারপাশের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এর জন্য রাস্তাঘাটে চলাচলে অপরিচিতদের দেওয়া খাদ্য, পানীয়, কাগজ গ্রহণ না করা এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সযত্নে নিজ দায়িত্বে রাখা অপরিহার্য। যাতায়াতের পুরোটা সময় মাস্ক পরিধান, সঙ্গে পকেট স্যানিটাইজার রাখা জরুরি। উপরন্তু, রাইড-শেয়ার অ্যাপ ব্যবহার ও আবাসিক হোটেলে স্প্রে ব্যবহার এড়িয়ে চলা এই সমস্যা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স