ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ , ১ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খোরশেদ সিন্ডিকেটেই যাচ্ছে নওপাজেকো

সংকটে বিদ্যুৎ খাত

ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় : ১৩-০২-২০২৫ ১২:১৯:৩৭ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ১৩-০২-২০২৫ ০১:২৭:০৮ অপরাহ্ন
সংকটে বিদ্যুৎ খাত ফাইল ছবি
নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (নওপাজেকো) বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) অধীন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি। প্রায় ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় এ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) ছিলেন খোরশেদ আলম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৯ সাল থেকে দেশে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে, সবকটিই তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন একক হাতে। নিজের ইচ্ছামতো কোম্পানি পরিচালনার জন্য নিজস্ব পছন্দের কর্মকর্তাদের নিয়ে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট, যা নওপাজেকোতে ‘খোরশেদ সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত। এই সিন্ডিকেটে খোরশেদ আলমের অন্যতম সহযোগী ছিলেন মশিউর আলম। নিজেদের পকেট ভরতে এই সিন্ডিকেট তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাবান আমলাদের সুবিধা দিয়ে বড় বড় প্রকল্প অনুমোদন করাতেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এমন নানা অভিযোগে খোরশেদ আলমকে অপসারণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে নিজে না থাকলেও আস্থাভাজন মশিউরকে নওপাজেকোর এমডি বানাতে খোরশেদ আলম তৎপর হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

খোরশেদ সিন্ডিকেটের সেই মশিউর রহমান এখন খুলনার রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক (পিডি)। প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্র বর্তমানে কমিশনিং পর্যায়ে রয়েছে। তবে জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের সরবরাহ নিয়ে নিশ্চয়তা না মেলায় উৎপাদনে যেতে পারবে না কেন্দ্রটি। অদূর ভবিষ্যতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্যাস পাওয়া নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। ফলে বিপুল অঙ্কের ঋণের টাকায় নির্মাণ করা হলেও উৎপাদন ছাড়াই পড়ে থাকবে কেন্দ্রটি। কাজে না এলেও সরকারকে পরিশোধ করে যেতে হবে বিদেশি ঋণ। নির্মাণ কাজ শেষ হলেও উৎপাদন শুরু না হওয়ার কারণ হিসেবে জানা যায়, প্রকল্পটি অনুমোদনের আগে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি, গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়নি এবং ট্রান্সমিশন লাইনের ক্ষমতা যাচাই করা হয়নি। এসব কারণে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

রূপসার আগে খুলনার আরও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পিডি ছিলেন মশিউর রহমান। খুলনা ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের পিডি হিসেবেও তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন সাবেক এমডি খোরশেদ আলম। প্রকল্পটি এক পর্যায়ে উৎপাদনে গেলেও নানা জটিলতায় গত দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে কার্যক্রম। আলোচিত ও বিতর্কিত এই দুই প্রকল্পের পেছনে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করা হলেও কোনো ফল আসছে না।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই দুই প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম, প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আপত্তি থাকলেও ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) ঠিকাদারকে অবৈধ সুবিধা প্রদান, প্রভাব খাটিয়ে সাবেক এমডির নিকটাত্মীয়কে প্রকল্পের নির্মাণকাজ দেওয়া, সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়া, চুক্তি অনুযায়ী আউটপুট না এলেও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, বিতর্কিত এই দুই প্রকল্পের নানা অনিয়মের অভিযোগে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অন্তর্বর্তী সরকারও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে। এর মধ্যেই বিতর্কিত এই দুই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মশিউর রহমানকে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সাবেক এমডি খোরশেদ আলম।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড খুলনা ও দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালকের বিরুদ্ধে ৮ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের পরিচালক মো. আবুল হাসনাতকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি এরই মধ্যে চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে আলোচ্য প্রকল্পের বিভিন্ন তথ্য চেয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নওপাজেকোর বর্তমান এমডির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেই হিসেবে এই পদের জন্য গত ডিসেম্বরে নিয়োগ সার্কুলার দেয় প্রতিষ্ঠানটি। সার্কুলার অনুযায়ী এমডি পদে নিয়োগ পেতে আবেদন করেন মশিউর রহমান। আগামীকাল এমডি পদের জন্য মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। মৌখিক পরীক্ষার জন্য এরই মধ্যে একটি শর্টলিস্ট করেছে নওপাজেকো কর্তৃপক্ষ। ওই লিস্টে রয়েছে মশিউর রহমানের নাম।

নওপাজেকো সূত্রে জানা গেছে, এমডি পদে নিয়োগের জন্য সিরিয়ালের প্রথম দিকেই রয়েছেন মশিউর রহমান। আর তাকে এমডি বানাতে দূর থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের ‘মাফিয়া’খ্যাত খোরশেদ আলম সিন্ডিকেট। খোরশেদুল আলম নওপাজেকোর ওপর নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তার আস্থাভাজন মশিউর রহমানকে নিয়োগের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, চাকরি থেকে অপসারণ সত্ত্বেও আড়াল থেকে বিদ্যুৎ খাত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন খোরশেদ আলম। কারণ রূপসা ৮শ মেগাওয়াট ও খুলনার ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে খোরশেদুল আলমের অনিয়ম ও অবৈধ কাজের অংশীদার ছিলেন প্রকল্প পরিচালক মশিউর রহমান। এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তি নওপাজেকোর এমডি হিসেবে নিয়োগ পেলে খোরশেদ আলম সিন্ডিকেট থেকে বিদ্যুৎ খাত বের হতে পারবে না। একই সঙ্গে অনিয়ম দুর্নীতি অব্যাহত থাকবে। নিয়োগের বিষয়ে জানতে নওপাজেকোর পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যানকে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বিষয়টি অবহিত করে মন্তব্য জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘আলোচিত এই দুই প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগে তদন্ত চলছে। একই সঙ্গে দুদকও বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে। সুতরাং এমন বিতর্কিত কাউকে সরকারের বিবেচনায় রাখার সুযোগ নেই। তার মতো একজন ব্যক্তি নর্থওয়েস্টের এমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না।’প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের অভিযোগসহ সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য জানতে প্রকল্প পরিচালক মশিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। মেসেজে দিয়েও সাড়া মেলেনি।

বাংলাস্কুপ/প্রতিবদেক/এনআইএন
 
 


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ