মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চল
তিস্তার পানি গেলো কোথায়?
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
১২-০২-২০২৫ ০৫:১৭:২৬ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১২-০২-২০২৫ ০৫:১৭:২৬ অপরাহ্ন
ছবি: সংগৃহীত
বর্ষাকালে খরস্রোতা তিস্তাকে শুষ্ক মৌসুমে চেনাই যায় না। পানির সংকটে শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। শুধু নদী নয়, ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকায় উত্তরাঞ্চল মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। লালমনিরহাট অংশ এখন মৃতপ্রায়। ফলে লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা ঝুঁকিতে পড়েছে। জীববৈচিত্র্য প্রায় বিলীন। জেলে আর মাঝিদের নেই কর্মব্যস্ততা। থেমে গেছে। থমকে গেছে লাখো পরিবারের উপার্জন। জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে পড়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন এ অঞ্চলের মানুষ।
জানা গেছে, তিস্তা বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। কয়েকটি বাঁধ, রাবার ড্যাম, পানি প্রত্যাহার, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনসহ বিভিন্ন বাধার মুখে পড়ে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের গতি হারিয়েছে নদীটি। এসব কারণে কী শুষ্ক কী বর্ষা; বেশিরভাগই সময় তিস্তার বাংলাদেশ অংশে পানি থাকে না। এতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা। বছরের বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশ অংশে পানি থাকে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত তিস্তা রেলসেতু, তিস্তা সড়ক সেতু ও গংগাচড়া শেখ হাসিনা সেতু দাঁড়িয়ে আছে ধুধু বালুচরের ওপর। ব্রিজ থাকলেও হেঁটেই নদী পার হচ্ছেন স্থানীয়রা। তবে মাঝেমধ্যে নদীর কিছু অংশে পানি আছে। যেটিকে ডোবার মতো দেখায়। সেখানে শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে পানি নিয়ে কৃষিজমিতে দিচ্ছেন চরের কৃষকরা। কিন্তু যে পরিমাণ ফসলি জমি, তাতে এই পানিতে কিছুই হয় না।
গত বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সদরের খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা, মোগলহাট, কুলাঘাটের, বড়বাড়ী, কালিগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডার, কাকিনা, ভোটমারী, পাটগ্রামের শ্রীরামপুর, পাটগ্রাম, বুড়িমারী, দহগ্রাম, জগৎবেড়, বাউরা, আদিতমারীর মহিষখোঁচা, দুর্গাপুর, হাতীবান্ধার ডাউয়াবাড়ী, সিন্দুর্ণা, গড্ডিমারী, বড়খাতা, সিংগিমারী ও পাটিকাপাড়া ইউনিয়ন। তিস্তা লাগোয়া এসব ইউনিয়নে বন্যার ক্ষত এখনও শুকায়নি।
৬৫ বছরের রুস্তম আলী তিস্তা নদীর শুকনো স্থানে নৌকায় বসে বলেন, ‘আমার বাবা এই এলাকার তালুকদার ছিলেন। আমরা এখানে নদীর পাড়েই বড় হয়েছি। এখন তিস্তায় কোনও ঢেউ নেই। পানি নেই। তিন ভাগে ভাগ হয়েছে। দেশ স্বাধীনের আগে এখান থেকে নৌকায় চড়ে ত্রিমোহনী নদী দিয়ে তুসভান্ডার জমিদার বাড়ির ঘাটে গিয়েছিলাম। এখন সেগুলোর অস্তিত্ব নেই। বছরের বেশিরভাগই সময় নদী শুকনো থাকে। আমাদের জীবন-জীবিকা বহু বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে।’ বারোঘরিয়া গ্রামের ৭০ বছরের বজলুর রহমান বলেন, ‘তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। বর্ষায় কিছুটা পানি এলে নদীভাঙন শুরু হয়। আমরা অনেকে বসতভিটা হারিয়েছি। আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ।’
তিস্তা পাড়ের কৃষক আব্দুল খালেক বলেন, ‘বর্ষায় প্রচুর পানি ছেড়ে দেওয়ায় সৃষ্ট বন্যায় ফসলহানিসহ ঘরবাড়ি হারা হয় এই অঞ্চলের মানুষ। আবার শুষ্ক মৌসুমে ফসল রক্ষায় পানির প্রয়োজন হলেও তিস্তায় পানি দেয় না ভারত। ফলে শুষ্ক মৌসুমেও পানির অভাবে ফসল নষ্ট হচ্ছে তিস্তা পাড়ের। নদী শাসন ও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না থাকায় তিস্তা নদী এলাকার কৃষকের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে।’নৌকার মাঝি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বর্ষাকালে নৌকা ভাড়া দিয়ে দৈনিক চার-পাঁচশ টাকা আয় হতো। কিন্তু এখন পানিশূন্য তিস্তায় নৌকা চলে না। কোনো রকম সংসার চালাচ্ছি। আমরা খুব কষ্টে আছি।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নীলফামারীর সৈয়দপুর পওর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবু সৈয়দ মোহাম্মদ আমিনুর রশিদ বলেন, ‘আপাতত কয়েক হাজার কিউসেক পানি আছে। সেগুলো রাখার জন্য গত ১ জানুয়ারি থেকে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যে দুই-একটি খোলা রাখা হয়। এই পানি দিয়ে দিনাজপুর, রংপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটের কিছু অংশকে সেচের আওতায় আনা হয়।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি নিয়ে কালক্ষেপণের আর সুযোগ নেই।দায়িত্বশীলরা ইচ্ছে করলেই এটির সমাধান করতে পারেন। প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকা ক্ষতি হয় আমাদের। তিস্তা মহাপরিকল্পনার নামে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এবার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সরেজমিনে ঘুরে গেছেন। তিনি দায়িত্বে আছেন। আশা করছি, এবার সমাধান হবে।’
একাত্তরের গেরিলা লিডার ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের’ নেতা এসএম শফিকুল ইসলাম কানু বলেন, ‘আমাদের দেশের মূল সমস্যাটা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতায় থাকার জন্য বিএনপি আওয়ামী লীগ কেউই চায় না, ভারতের কাছ থেকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে। ন্যায্য হিস্যা চাইলে না জানি ক্ষমতা হারায়। যেকোনোভাবে বাংলাদেশ সরকারকেই ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে হবে।’
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে তিস্তা প্রকল্প শুরু হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে চুক্তিটি হয়নি। তখন থেকে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে।
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স