রেলওয়ের রানিং স্টাফরা কর্মবিরতিতে যাওয়ায় সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দিবাগত রাত ১২টা থেকে তারা কর্মবিরতিতে গেছেন। মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স (ভাতা) যোগ করে পেনশন এবং আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে জটিলতার নিরসন না হওয়ায় ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতি’ এই কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করছে।এদিকে, ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। রাজধানীর কমলাপুরসহ সারা দেশের রেল স্টেশনগুলোতে বহু যাত্রী ট্রেনের অপেক্ষায় রয়েছেন। অনেকে ফিরে গেছেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী মো. মজিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা রার্নিং স্টাফরা রাত ১২টা থেকে কর্মবিরতি পালন করছি। এ কারণে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। আমাদের সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।’রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এ বি এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘রার্নিং স্টাফরা কর্মবিরতি পালন করছেন। এ কারণে সকাল থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কোনও ট্রেন গন্তব্যে ছেড়ে যায়নি। কর্মবিরতি পালনকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।’
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘রার্নিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে সকাল থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কোনও ট্রেন ছেড়ে যায়নি এবং কোনও ট্রেন আসেনি। চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে সকাল ৬টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে চট্টলা, ৭টায় কক্সবাজারগামী স্পেশাল, সাড়ে ৭টায় সুবর্ণ এক্সপ্রেস, ৭টা ৪০ মিনিটে সাগরিয়া এক্সপ্রেস ও ৭টা ৫০ মিনিটে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। রার্নিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে এসব ট্রেন গন্তব্যে ছেড়ে যায়নি।’
ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট নাজমুল হক খান বলেন, ‘রেলের রানিং স্টাফরা বিভিন্ন দাবিতে সোমবার দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে কর্মবিরতিতে যায়। এরপর থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন ময়মনসিংহ স্টেশনে এসে অবস্থান করছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ৩৭ আপটন ভোর ৩টার সময় এসে ময়মনসিংহে অবস্থান করছে। আরেকটি ট্রেন ভুয়াপুর থেকে ছেড়ে এসেছে। চট্টগ্রামগামী থার্টি এইট ডাউন ট্রেনটিও স্টেশনে রয়েছে। রেলের চালক, সহকারী চালকসহ অন্যান্য কর্মচারীরা তাদের দাবি আদায় না হওয়ায় এ কর্মবিরতিতে আছেন।’
ময়মনসিংহ রেলওয়ে রানিং স্টাফ কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘দাবি আদায়ে এর আগেও আমরা কর্মবিরতিতে গিয়েছিলাম। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে আমরা কর্মবিরতি স্থগিত রেখেছিলাম। এরপরও আমাদের দাবি আদায় না হওয়ায় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশে সারা দেশের মতো ময়মনসিংহ সোমবার রাত ১২টা এক মিনিট থেকে আমরা ট্রেন চালানো বন্ধ রেখেছি। আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজে যোগ দেবো না।’রাজশাহী রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজশাহীতে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। আমাদের অধিকার ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।’
রেলওয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী একজন রানিং স্টাফ (চালক, সহকারী চালক, গার্ড, টিকিট চেকার) ট্রেনে দায়িত্ব পালন শেষে তার নিয়োগপ্রাপ্ত এলাকায় হলে ১২ ঘণ্টা এবং এলাকার বাইরে হলে আট ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পান। রেলওয়ের স্বার্থে কোনও রানিং স্টাফকে তার বিশ্রামের সময় কাজে যুক্ত করলে বাড়তি ভাতা-সুবিধা দেওয়া হয়; যা রেলওয়েতে ‘মাইলেজ’ সুবিধা হিসেবে পরিচিত।২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় মাইলেজ সুবিধা সীমিত করতে রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে আনলিমিটেড মাইলেজ সুবিধা বাদ দিয়ে তা সর্বোচ্চ ৩০ কর্মদিবসের সমপরিমাণ করার কথা জানানো হয়। এ ছাড়া বেসামরিক কর্মচারী হিসেবে রানিং স্টাফদের পেনশন ও আনুতোষিক ভাতায় মূল বেতনের সঙ্গে পাওয়া কোনও ভাতা যোগ করার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। এরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রানিং স্টাফরা।
মাইলেজ সুবিধা পুনর্বহালের দাবিতে তিন বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছেন তারা। কয়েক দফায় অতিরিক্ত কাজ থেকে বিরত থাকাসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। তবে বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন রেলওয়ের মহাপরিচালক, রেলসচিব, রেলমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশ্বাসে আন্দোলন থেকে সরে আসেন।
গত ২২ জানুয়ারি দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের বটতলী পুরাতন রেলস্টেশনে সংবাদ সম্মেলন করেন বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী মজিবুর রহমান বলেন, ‘রেলওয়ের রানিং স্টাফরা ১৬০ বছর ধরে অবসরের পর মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক পেয়ে আসছেন। রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক যেকোনও দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে ট্রেন সচল রাখেন রানিং স্টাফরা। তাদের কোনও সাপ্তাহিক ছুটি বা জাতীয় দিবসের বন্ধ নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিজেদের দুর্নীতি ও অর্থ অপচয় ঢাকতে অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর রেলওয়ের রানিং স্টাফদের বেতন, পেনশন ও আনুতোষিক কমিয়ে দেয়।’সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বর্তমান সরকারকে তিনবার সময় দেওয়া হয়েছে। তারা স্থায়ী সমাধান চান। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পত্র এবং নতুন নিয়োগ পাওয়া রানিং স্টাফদের বৈষম্যমূলক শর্ত প্রত্যাহার করতে হবে।
বাংলাস্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন