গুড়ের মেলায় কোটি টাকার স্বপ্ন!
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
১৫-০১-২০২৫ ০৮:৩৪:৫৬ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৫-০১-২০২৫ ০৮:৩৪:৫৬ অপরাহ্ন
সংবাদচিত্র : সংগৃহীত
‘স্বাদে সেরা, গন্ধে ভরা/ খেজুর গুড়ে মনোহরা’ এ প্রতিপাদ্যে বুধবার (১৫ জানুয়ারি) থেকে যশোরের চৌগাছায় শুরু হলো খেজুর গুড়ের মেলা। তৃতীয়বারের মতো এ আয়োজন করেছে উপজেলা প্রশাসন। বেলা ১১টায় যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজহারুল ইসলাম ফিতা কেটে এবং বেলুন উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। চৌগাছা উপজেলা পরিষদ চত্বরে আয়োজিত এ মেলায় দুইশর মতো গাছি অংশ নেন।
উপজেলা প্রশাসন জানায়, যশোরের ঐতিহ্য খেজুর গুড় যেন স্থায়িত্ব পায়, সে লক্ষ্যেই এই মেলার আয়োজন। ভোক্তারা যেন খাঁটি খেজুরের গুড় কিনতে পারেন, সে কারণে তাদের সঙ্গে গাছিদের একটি সংযোগ তৈরি হয় এই মেলার মাধ্যমে। এবারের মেলাকে কেন্দ্র করে গাছিরা এক কোটি টাকার ঝোলা গুড় ও পাটালি বিক্রি করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
মেলায় স্টল নিয়ে গুড় ও পাটালি বিক্রি করছিল চৌগাছা শাহাদাত পাইলট হাই স্কুলের ছাত্র, এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী তামিম ইকবাল। সে জানায়, গত তিন বছর ধরে মেলায় স্টল দেয় সে। চৌগাছার যেসব গাছি ভেজালমুক্ত গুড়পাঠালি উৎপাদন করেন তাদের কাছ থেকে সেগুলো সংগ্রহ করে মেলায় বিক্রি করা হয়। লাভের উদ্দেশ্যে নয় বরং নির্ভেজাল গুড় প্রমোট করাই তাদের উদ্দেশ্য।
স্কাউটের ১৫ সদস্য এই মেলায় তামিমের সঙ্গে রয়েছে। একটি অংশ মেলার কোনায় তাফালে জিরেন রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করছে। ওই গুড়ও মেলায় বিক্রি করা হবে। তামিম বলে, ‘এখান থেকে যে লাভ হয় সেই টাকার সঙ্গে সদস্যদের টাকা যোগ করে আমরা পিকনিক করি।’ তাদের স্কাউট সদস্য ৯৫ জন। তামিমের স্টলে তিলের পাটালি ৭০০ টাকা, সাধারণ পাটালি ৬০০ টাকা এবং গুড় ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
আরতি রানী হালদার এসেছেন চৌগাছা ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রাম থেকে। তিনিও গত তিন মেলায় স্টল দেন। আরতি বলেন, ‘আমাদের খেজুর গাছের সংখ্যা ১২০টি। কাকা আমলের হালদার গাছ কাটেন। আমি আর কাকি ভারতী হালদার গুড় ও পাটালি তৈরি করি। আমি গুড় বিক্রি করছি ৪০০ টাকা কেজি দরে। গতবারের মেলায় সাত মণ গুড় ও পাটালি বিক্রি করেছিলাম। আশা করছি এবারও ভালো হবে।’
সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের সুখপুকুরিয়া গ্রামের গাজী আলমগীর হোসেন শুধু পাটালি এনেছেন। তিনি বিক্রি করছেন ৫০০ টাকা কেজি ধরে। গত মেলায় দুই দিন এসেছিলেন, বিক্রি করেছিলেন দুই মণের বেশি।’
মেলায় আসা নারী উদ্যোক্তা ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘গতবারের মতো এবারও গুড়, নারকেল ও তালের তৈরি পিঠা এনেছি। আমার স্টলে নানা ধরনের পিঠা রয়েছে। এর মধ্যে ভাপাপুলি বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা দরে, ভাপা পিঠা ১০ টাকা, ডিমের পিঠা ১৯ টাকা এবং তালের পিঠা ৫ টাকা করে। বেচা-বিক্রি মোটামুটি।’
ফুলসারা ইউনিয়নের জামিরা গ্রামের গাজী আব্দুল গনি বলেন, ‘গত তিন মেলায় এসেছি। প্রতিদিন ৩০ কেজি থেকে এক মণের মতো ঝোলা গুড় ও পাটালি বিক্রি করি। মেলায় বিক্রিতে লাভ বেশি। এবার তিলের পাটালি, সাধারণ পাটালি এবং গুড় এনেছি। এগুলো যথাক্রমে ৭০০ টাকা, ৬০০ টাকা ও ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এই মেলার মাধ্যমে অনেকেই ফোন দিয়ে গুড়-পাটালি কেনেন। এই মৌসুমে মোটামুটি ভালোই বিক্রি হয়।’
খুলনার একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি শেখ মাসুদুল ইসলাম এসেছিলেন গুড়ের মেলায়। তিনি বলেন, ‘আমরা যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার খাজুরা এলাকায় গাছিদের নিয়ে কাজ করছি। যশোরের ঐতিহ্যবাহী খাজুরার পাটালি ও গুড় স্থানীয় গাছিরা উৎপাদন করেন। আজকের মেলায় তারাই এসেছেন। এ ছাড়া সুন্দরবনের মধু, কেওড়ার আচারও রয়েছে আমাদের স্টলে। জাপানি একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা খাজুরাই খাঁটি গুড় উৎপাদন করি। আমাদের উৎপাদিত গুড়ের দাম কেজিপ্রতি ৭৯৯ টাকা। সুন্দরবনের মধু ২৫০ গ্রাম গ্রাম ৫২০ টাকা, কেওড়ার আচার ২২০ টাকা।’
মেলায় আসা সিংহঝুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হামিদ মল্লিক বলেন, ‘২০২৩ সালে চৌগাছায় গুড়ের মেলার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন ইউএনও ইরুফা সুলতানার ঐকান্তিক চেষ্টায় চৌগাছার এই খেজুর গুড় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়। এরপর বর্তমান ইউএনও সুস্মিতা সাহা মেলার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। এই মেলার মাধ্যমে সারা দেশে যেন আমরা নির্ভেজাল গুড় সরবরাহ করতে পারি সেই প্রত্যাশা করছি।’
তিন দিনব্যাপী এই গৌড় মেলার বিষয়ে চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুস্মিতা সাহা বলেন, ‘যশোরের খেজুর গুড়- পাটালির যে ঐতিহ্য তা যেন বজায় থাকে মূলত সে কারণেই এই মেলা। আমরা চাই, গাছিরা যেন তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম ও বাজার পান। এই মেলার মাধ্যমে গাছিরা উপস্থিত হন এবং তাদের উৎপাদিত গুড়, পাটালি বাজারজাত করতে পারেন। ভোক্তাদের সঙ্গে বিক্রেতাদের একটা লিংকেজ তৈরি হয়। এর ফলে এই মৌসুমে তারা এক কোটি টাকার বেশি গুড় ও পাটালি বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছি।’
তিন দিনব্যাপী এ মেলায় গাছিরা তাদের তৈরি নির্ভেজাল পাটালিসহ বিভিন্ন প্রকারের খেজুর গুড় নিয়ে উপস্থিত হবেন। মেলা চলাকালে তিন দিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এখান থেকে ক্রেতারা খুব সহজেই খাঁটি খেজুর গুড় কিনতে পারবেন।
মেলার শেষদিন সমাপনী অনুষ্ঠানে সেরা গাছিদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দেবেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চৌগাছা উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে প্রায় ২৫ হাজার খেজুরের গাছ থেকে গাছিরা রস আহরণ করেন। ইতোমধ্যে গাছিদের নিয়ে সমাবেশ করা হয়েছে।
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধ/এনআইএন/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স