সুন্দরবনে হরিণ নিধনের মহোৎসব
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
১১-০১-২০২৫ ০৫:২৯:৩৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১১-০১-২০২৫ ০৫:২৯:৩৯ অপরাহ্ন
সংবাদচিত্র : সংগৃহীত
পৃথিবীর সব থেকে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে হরিণের। সুন্দরবন দর্শনার্থী ও বনসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা বেড়েছে। এর বাঁকে বাঁকে এখন হরিণের দেখা পাওয়া যায়। বনের খাল বা নদীর ধারে দল বেঁধে হরিণের চলাফেরার দৃশ্য হরহামেশা চোখে পড়ছে। সুন্দরবনে মায়া ও চিত্রা নামের দুই প্রজাতির হরিণ দেখা যায়। তবে হরিণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে নিধনও। চোরাশিকারি চক্র অবাধে হরিণ শিকার করে চলেছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সর্বশেষ জরিপের তথ্যমতে, সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালে হরিণের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার। সে হিসেবে ১৯ বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে হরিণ বেড়েছে ৫৩ হাজার ৬০৪টি। গত এক বছরের ব্যবধানে হরিণের সংখ্যা আরো বেড়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘কয়েক বছরে বনের জীব বৈচিত্র্যে পরিবর্তন এসেছে। এখন সুন্দরবনে গেলেই হরিণ দেখা যাচ্ছে, যা আগে ছিল না। হরিণের সঙ্গে বাঘও দেখতে পাচ্ছেন সুন্দরবন দর্শনার্থীরা।’
হরিণের সংখ্যা বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি জানান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বন বিভাগের নিয়মিত টহল এবং বনে দস্যু কমার পাশাপাশি রাসমেলা বন্ধ হওয়ায় হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমেছে। বনে সারা বছরই দস্যুরা ও বছরের শেষের দিকে দুবলারচরে রাসমেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ আসত। ওই সময় বিপুল পরিমাণ হরিণ শিকার করা হতো।
তবে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, সুন্দরবনে হরিণ শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। এক মাস ধরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কয়েকটি চোরাশিকারি চক্র। গরু ও খাসির মাংসের তুলনায় হরিণের মাংসের দাম কম হওয়ায় সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় এ বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা বাড়ছে।
খুলনার সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলছেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে বাঘ হত্যা কিছুটা কমলেও একেবারে তা বন্ধ হয়নি। বাঘের প্রধান খাবার হরিণ শিকার হচ্ছে প্রায়ই। বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ চিত্রা হরিণ শিকার করছে কয়েকটি চক্র। যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া আটক হয়, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি পরিমাণ হরিণ শিকার করা হয়।’
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, বনের পাশে যাদের বাড়ি, তারাই বেশি হরিণ শিকারের সঙ্গে যুক্ত। খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং বাগেরহাটের মোংলা ও শরণখোলার মানুষ বেশি হরিণ শিকার করে।
খুলনার সুন্দরবনঘেরা কয়রা উপজেলাটিকে ঘিরে রেখেছে কপোতাক্ষ, কয়রা ও শাকবাড়িয়া নদী। উপজেলাটির তিন দিক নদীবেষ্টিত এবং সাতটি ইউনিয়নই সুন্দরবনের সীমানায় অবস্থিত। এ উপজেলার গ্রামগুলোর প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সুন্দরবনকেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ উপজেলার ৩০টির বেশি চোরাশিকারি চক্র নির্বিচারে হরিণ নিধন করছে। হরিণ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বজবজা ও খাসিটানা বন টহল ফাঁড়ি এলাকা।
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা শহিদুল সরদার বলেন, ‘উপজেলার একটি ছোট নদী পেরোলেই সুন্দরবনের গহিন জঙ্গল। পেশাদার হরিণ শিকারিরা গোপনে সুন্দরবনে ঢুকে নাইলনের দঁড়ির ফাঁদ পেতে রাখেন। চলাচলের সময় হরিণ সে ফাঁদে আটকে যায়। তারপর বনরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হরিণের মাংস বিক্রি করা হয়।’
সুন্দরবনসংলগ্ন খুলনার দাকোপ উপজেলার নলিয়ান গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় সংবাদকর্মী মো. আবুল বাশার বলেন, ‘ঢাংমারী, খাজুরা, বানীশান্তা, সুতারখালী ও কালাবগি গ্রামের চিহ্নিত হরিণ শিকারিরা নিয়মিত হরিণ শিকার করে। নদীর জোয়ারে রাতে ও দিনে ২০-২৫ জন দলবদ্ধভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করে হরিণ শিকার করে।’এছাড়া মোংলা, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বেশকিছু গ্রামে হরিণ শিকারিদের তৎপরতা রয়েছে।
সুন্দরবনে হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘মূলত শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের ভেতর খাল ও নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হরিণের বিচরণ বেড়ে যায়। যে কারণে চোরাশিকারিরা এ সময় তৎপর হয়।’
বাংলা স্কুপ/ প্রতিনিধি/ এনআইএন/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স