ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২৫ , ২৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​বিদায়ী বছরের সেরা ব্যক্তি আবু সাঈদ!

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ৩১-১২-২০২৪ ০২:৩৩:১১ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ৩১-১২-২০২৪ ০২:৩৫:০০ অপরাহ্ন
​বিদায়ী বছরের সেরা ব্যক্তি আবু সাঈদ!
ঘটনাবহুল ২০২৪ সাল। রংপুরে ঘটে গেছে বহু আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা। এমনকি রংপুরের ‘আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড বিশ্বজুড়ে নাড়াও দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতন ও অন্যায়ের প্রতিবাদে পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে সাহস নিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদের আত্মত্যাগ। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সামনে আবু সাঈদের বুকে বিবেকবর্জিত নতজানু পুলিশের গুলি চালানোর সেই দৃশ্য দেখেছে বিশ্ববাসী।

পুলিশের ছোড়া একের পর এক রাবার বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া আবু সাঈদের মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দ্রোহের আগুন হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার দমননীতি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। ছাত্র-জনতার ক্রোধ আর ক্ষোভের দীর্ঘ নিশ্বাস পরিণত হয় অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে। তরান্বিত হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদায় ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতার মসনদে থাকা শেখ হাসিনা।

আবু সাঈদের মৃত্যুতে তরান্বিত হাসিনার পতন
১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় পুলিশসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা লীগ, ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা। ওইদিন প্রায় ২০০ রাউন্ড গুলি ও রাবার বুলেট ছোড়ে তারা। এতে পুলিশের গুলিতে মারা যান আবু সাঈদ। নিহত আবু সাঈদ বেরোবির ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। এর পরদিন ১৯ জুলাই রংপুর সিটি বাজারের সামনে আন্দোলনকারীদের দমনে ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এদিন সাজ্জাদ হোসেন, মুসলিম উদ্দিন মিলন, আব্দুল্লাহ আল তাহির, মেরাজুল ইসলাম মেরাজ নিহত হন। এসময় আহত হন শতাধিক ছাত্র-জনতা।

উল্লেখিত পরিস্থিতিতে সারা দেশে ২০ জুলাই কারফিউ দেয় হাসিনা সরকার। এরপরও দমানো যায়নি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একের পর এক কর্মসূচি। শেষ পর্যন্ত ৪ আগস্ট রংপুর নগরী অস্ত্রধারী আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। হামলার শিকার হয়ে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এদিন রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা হারাধন রায় এবং তার গাড়িচালক কমল রায়সহ পাঁচজন মারা যান।

এত এত মৃত্যুর খবরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে সাহস নিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদের আত্মত্যাগের বিরল দৃশ্যটি। যা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে, কেঁদেছে বহু মানুষ। অনুপ্রাণিত হয়েছে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে আওয়াজ তোলা লাখ লাখ মানুষকে।

আবু সাঈদ হত্যা মামলায় কলেজছাত্র গ্রেপ্তার
শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আন্দোলনকারী কলেজ ছাত্র আলফি শাহরিয়ার মাহিমকে (১৬) আসামি দেখিয়ে গ্রেপ্তারের বিষয়টি ছিল বেশ আলোচিত। যদিও ১৯ জুলাই মাহিমকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি অগোচরেই ছিল। একমাত্র ছোট ভাইয়ের কোনো খোঁজ না মেলায় ৩১ জুলাই মাহিমের বোন সানজানা আখতার স্নেহা ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিলে বিষয়টি আলোচনায় আসে। কিশোর শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। পরবর্তীতে ১ আগস্ট আদালত তাকে জামিন আদেশ দেন।

পুলিশ সদস্যের ফেসবুক পোস্টে প্রশাসনে তোলপাড় 
২০ আগস্ট রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরপিএমপি) এক উপ-পরিদর্শকের (এসআই) ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। স্ট্যাটাসে দাবি করা হয়- ‘গত ১৯ জুলাই রংপুর রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি), বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) নিজেই রাইডকার দিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়েন।’ এই ফেসবুক স্ট্যাটাসটি রংপুর জেলা ও মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেলেও শেয়ার করেন এসআই মজনু। এরপর সেটি নিয়ে রংপুরসহ সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

চাকরি ছাড়লেন আবু সাঈদের দুই ভাই 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদের দুই ভাই রমজান আলী ও আবু হোসেনের চাকরি ছেড়ে দেয়ার ঘটনাটিও আলোচিত ছিল। ৯ অক্টোবর রমজান আলীকে বাংলাদেশ প্রতিদিনের রংপুর ব্যুরো অফিসের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী এবং আবু হোসেনকে টিভি চ্যানেল নিউজ-২৪ এর রংপুর ব্যুরো অফিসের জ্যেষ্ঠ নির্বাহীর পদে নিয়োগ দিয়েছিল বসুন্ধরা গ্রুপ। ওই দিন আবু সাঈদের ছোট বোন সুমী খাতুনকে চাকরি দেয় বেরোবি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু হঠাৎ করে নভেম্বরের শুরুতে আবু সাঈদের দুই ভাই চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়ায় তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক কৌতুহল তৈরি হয়।

শিক্ষক নিবন্ধনের ফল প্রকাশ, পাস করেছেন শহীদ আবু সাঈদ
বেরোবির শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন। ১৪ অক্টোরবার এনটিআরসিএর ওয়েবসাইটে নিবন্ধন পরীক্ষার লিখিত ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, আবু সাঈদ ইবতেদায়ি সহকারী শিক্ষক হিসেবে লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন। ফলাফল প্রকাশের পর ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দেন বেরোবির বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক শামসুর রহমান সুমন।

বেরোবির সাবেক প্রক্টর সাময়িক বরখাস্ত
বেরোবি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক প্রক্টর ড. মো শরিফুল ইসলামকে চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মো. হারুন-অর রশিদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এটি জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, আপনি শরিফুল ইসলাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এর ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলায় (আরপিএমপি তাজহাট থানার মামলা নম্বর ৩, তারিখ ১৯-০৮-২০২৪ ও জিআর মামলা নম্বর-১১১/২৪, দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ৩০২/২০১/১৪৯/৩৪) গত ১৯ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ায় সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৩৯(২) ধারা মোতাবেক তাকে বরখাস্ত করা হয়।

আবু সাঈদ হত্যা মামলায় নতুন আরো ৭ আসামি অন্তর্ভুক্ত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামির তালিকায় নতুন আরো ৭ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাদের সম্পৃক্ততা এবং এজাহারকারীর দাখিল করা আলামত খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালতের বিচারক।শহীদ আবু সাঈদের ভাই রমজান আলীর করা হত্যা মামলায় গত ১৪ অক্টোবর আদালতে আবেদন করা হলে দাখিল করা ছবি ও সিসি টিভি ফুটেজ জব্দ ও গ্রহণের আদেশ দেওয়া হয়। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাজহাট আমলি আদালতের বিচারক মো. আসাদুজ্জামান গতকাল সোমবার বিকালে ওই আবেদন মঞ্জুর করেন।

নতুন সাত আসামি হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বেরোবির সাবেক উপাচার্য ড. হাসিবুর রশিদ, সাবেক প্রক্টর ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা শাখা) শাহ নূর আলম পাটোয়ারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক ও অস্থায়ী চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নূরুন্নবী, সুরতহাল প্রস্ততকারী কর্মকর্তা এসআই তরিকুল ইসলাম ও সুরতাহাল রিপোর্টের প্রতিস্বাক্ষরকারী ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ সাদাত।

আবু সাঈদ হত্যা ও শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনায় ৮১ জন অভিযুক্ত
বেরোবি ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা ও শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮১ জন অভিযুক্ত হয়েছেন। এরমধ্যে শিক্ষক দুইজন, কর্মকর্তা-কর্মচারী সাতজন ও শিক্ষার্থী ৭২ জন।২৮ অক্টেরবার সোমবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৮তম সিন্ডিকেট মিটিং শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী বলেন

আবু সাঈদের কবর জিয়ারতে সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা
১ আগস্ট জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করেন। এরপর ৭ আগস্ট আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করতে রংপুরে আসেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। ১০ আগস্ট রংপুরে এসেছিলেন অন্তবরর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া। ১৪ আগস্ট বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ১৯ আগস্ট নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করেন।

বাংলা স্কুপ/ প্রতিবেদক/ এনআইএন/এসকে 


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ