নিয়ম ভঙ্গ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের কাকরাইল ডিভিশনের এক বিদ্যুৎ গ্রাহককে সংযোগ দেওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্ট ডিভিশনের অসাধু কর্মকর্তারা ওই গ্রাহকের কাছ থেকে 'বিশেষ সুবিধা' নিয়ে ঝুকিপূর্ণ সংযোগটি ১০ বছর ধরে চালু রেখেছেন। এতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছেন ওই গ্রাহকের স্থাপনার আশপাশের বাসিন্দারাও।
জানা যায়, ডিপিডিসির কাকরাইল ডিভিশনের সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের বিদ্যুৎগ্রাহক মাহবুব আলমের (কাস্টমার নং ১৬৩৫৮৭০৪) স্থাপনায় বাণিজ্যিক সংযোগের শুরুতেই লোড ছিল ৮ কিলোওয়াট। ওই ডিভিশনের প্রকৌশলীরা ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে তাঁর বিদ্যুতের লোড বৃদ্ধি করে ৪০ কিলোওয়াট বরাদ্দ দেন। মাহবুব আলমের ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৪০ কিলোওয়াট লোড বরাদ্দ থাকলেও ব্যবহার হতো ৯০ কিলোওয়াট! স্থাপনাটিতে একটি থ্রি ফেইজ মিটার দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু রয়েছে। ডিপিডিসির ইস্যুকৃত গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিলের নথি পর্যালোচনা করে এই চিত্র পাওয়া যায়।
সর্বশেষ বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানিগুলোতে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগকারীরা ৮০ কিলোওয়াট লোডের উপরে ব্যবহার করলে তাদের উচ্চচাপ সংযোগ নিতে হয়। অর্থাৎ ওই উচ্চচাপ গ্রাহককে তার স্থাপনায় নিজ খরচে ট্রান্সফরমার বসাতে হয় এবং বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন লাইসেন্সিং বোর্ড থেকে সাবস্টেশন নির্মাণ পরবর্তী ছাড়পত্র নিতে হয়। সরকারকে রাজস্ব দিয়ে এই ছাড়পত্র পাবার পরেই ওই গ্রাহককে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানির কাছে নতুন সংযোগ চেয়ে আবেদন করতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদপ্তরেরও অনাপত্তি ছাড়পত্র নিতে হয়, যার কোনোটাই এই গ্রাহকের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি।
ডিপিডিসির সর্বশেষ নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ নীতিমালা অনুযায়ী, নিম্নচাপ (এলটি) গ্রাহকদের ৪৯ কিলোওয়াট থেকে ৮০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত এলটিসিটি মিটার দিয়ে সংযোগ দেয়ার বিধান রয়েছে। আর ৮০ কিলোওয়াট থেকে ২০০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত আবাসিক গ্রাহককে এলটিসিটি মিটার এবং ৮০ কিলোওয়াট থেকে ২০০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ গ্রাহককে এইচটি মিটার দিয়ে সংযোগ দিতে হয়। এলটিসিটি মিটার কিনতে একজন গ্রাহককে প্রায় ৪৯ হাজার টাকা এবং এইচটি মিটার কেনার ক্ষেত্রে গুনতে হবে ৩ লক্ষ টাকা। প্রশ্ন উঠেছে, বাণিজ্যিক এই গ্রাহককে কেন একটি থ্রি ফেইজ (যার মূল্য ৫-৬ হাজার টাকা) মিটার দিয়ে সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুতের ট্যারিফ অনুযায়ী মাহবুব আলমের বাণিজ্যিক লাইনটি উচ্চচাপ সংযোগে থাকার কথা, কিন্তু তা নিম্নচাপে রয়েছে। ১০ বছরেও ওই গ্রাহককে কেন ডিভিশনের প্রকৌশলীরা উচ্চচাপ সংযোগে রাখেনি, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এতে ডিপিডিসি তার ট্রান্সফরমার ওভারলোড ও ডিস্ট্রিবিউশন বিদ্যুৎ লাইনে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং উচ্চচাপ সংযোগ না হওয়ায় সরকার প্রতিমাসে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। বাণিজ্যিক এই বিদ্যুৎ লাইনটি উচ্চচাপ সংযোগে না থাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। কেননা, ওই গ্রাহক দীর্ঘদিন থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছে ৯০ কিলোওয়াট লোড। ডিপিডিসির নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কার স্বার্থে ওই গ্রাহকের সংযোগটি নিম্নচাপে দিয়ে রাখা হয়েছে, তাও দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, প্রতিবছরই রাজধানীসহ সারাদেশে বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট ও বিদ্যুৎলাইনে ওভারলোড এবং গ্যাস লিকেজের কারণে আগুণ লেগে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ, চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে কাকরাইল ডিভিশনের আওতাধীন বেইলি রোডে গ্রিন কোজি নামক বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন প্রাণ হারান, দগ্ধ হন অনেকেই।
কাকরাইল ডিভিশনের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক দুই কর্মকর্তা জানান, বাণিজ্যিক এই গ্রাহকের বিদ্যুৎ লাইনের ট্যারিফটি 'বিশেষ কারণে' প্রকৌশলীরা দীর্ঘদিন যাবত অনুসরণ করেননি। তবে এই লাইনটি উচ্চচাপ সংযোগ করার জন্য এক প্রকৌশলী উদ্যোগ নিলেও বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী এবং সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসানের চাপে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।
এ বিষয়ে ডিপিডিসির কাকরাইল ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মেহেদী হাসান ভূঁইয়া মুঠোফোনে বাংলা স্কুপকে বলেন, আমি বিষয়টি অবগত নই। ওই বিদ্যুৎ গ্রাহকের ফিডার ইনচার্জ প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে মন্তব্য করতে পারবো।
এদিকে কাকরাইল ডিভিশনের ওই বিদ্যুৎগ্রাহকের পার্ক রোড ফিডারের (বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন) দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী তৌফিক আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁরা ফোন রিসিভ করেননি।
ডিপিডিসির কাকরাইল ডিভিশন একটি ভিভিআইপি ডিভিশন। এই ডিভিশনের আওতায় রয়েছে মন্ত্রিপাড়া, জাজেস কোয়ার্টার, হাসপাতালসহ জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এই ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে রয়েছেন একজন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী। সাধারণ প্রকৌশলীরা মনে করেন, এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ ডিভিশনে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও দূরদর্শিতাসম্পন্ন কর্মকর্তা প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি
গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিদ্যুৎচুরি! শীর্ষক বাংলা স্কুপের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কাকরাইল ডিভিশনের প্রকৌশলী ও কর্মচারীদের অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। পরবর্তীতে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি করলেও মূল অভিযুক্তরা রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে!
বাংলা স্কুপ/বিশেষ প্রতিবেদক/আমিনুল কবীর/এনআইএন/এসকে