আদানি পাওয়ারের চুক্তি পর্যালোচনায় বাংলাদেশের চাপ
ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় :
১৯-১২-২০২৪ ০৬:৫৯:০০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৯-১২-২০২৪ ০৬:৫৯:০০ অপরাহ্ন
নয়াদিল্লির কাছ থেকে পাওয়া কর ছাড় সুবিধা গোপন করে ভারতীয় ব্যবসায়ী গৌতম আদানির মালিকানাধীন বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ার মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। এই চুক্তি নিয়ে পুনরায় আলোচনার বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশাপ্রকাশ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
২০১৭ সালে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কোম্পানি আদানি পাওয়ারের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় অবস্থিত কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে ২৫ বছর মেয়াদী একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নথিপত্র, উভয় পক্ষের চিঠি পর্যালোচনা এবং পিডিবির ছয় কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রয়টার্স বলেছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনও ধরনের দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়াই চুক্তিটি করেছিলেন এবং এর ব্যয় বাংলাদেশের অন্যান্য কয়লা বিদ্যুৎ চুক্তির তুলনায় অনেক বেশি। যে কারণে চুক্তিটি নিয়ে পুনরায় আলোচনার প্রত্যাশা করছে ঢাকা।
গত বছরের জুলাইয়ে বিদ্যুতের সরবরাহ শুরু হওয়ার পর থেকে আদানি পাওয়ারের অর্থ পরিশোধে পিছিয়ে রয়েছে ঢাকা। বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কাছে আদানি পাওয়ার কয়েক মিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে। যদিও বকেয়ার সঠিক পরিমাণ নিয়ে উভয়পক্ষের মাঝে বিরোধ রয়েছে।
জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রয়টার্সকে বলেছেন, আদানির সরবরাহ ছাড়াই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে, যদিও দেশের অভ্যন্তরীণ সব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চালু নেই।
গত আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যু হন শেখ হাসিনা; তার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করেন সমালোচকরা। গত দুই দশকের বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। শেখ হাসিনার পতনের পর গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
কর ছাড় নিয়ে আদানির চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে রয়টার্স। ব্রিটিশ এই বার্তা সংস্থা ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তিটি নিয়ে পুনরায় আলোচনা করার জন্য বাংলাদেশের পরিকল্পনা সম্পর্কেও বিস্তারিত প্রকাশ করছে। রয়টার্স বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে গত নভেম্বরে ২৬৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেওয়ার এক মামলায় আদানি ও তার সাত নির্বাহীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মার্কিন আদালতের এই ঘটনা বাংলাদেশের সঙ্গে করা চুক্তি পর্যালোচনায় আদানির ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশে আদানি পাওয়ারের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের অনিয়মের অভিযোগ নেই বলে দাবি করেছে কোম্পানিটি। আদানি পাওয়ারের একজন মুখপাত্র রয়টার্সের করা প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তারা চুক্তির সমস্ত বাধ্যবাধকতা রক্ষা করেছেন এবং ঢাকা চুক্তি পর্যালোচনা করছে এমন কোনও ইঙ্গিত তাদের কাছে নেই। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কর সুবিধা ও অন্যান্য বিষয়ে তোলা অভিযোগের কোনও জবাব দেয়নি আদানি পাওয়ার।
আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মাঝে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তি ও বাস্তবায়ন চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের করহার পরিবর্তন হলে সেই বিষয়ে বাংলাদেশকে দ্রুত অবহিত করতে হবে। একই সঙ্গে ভারত সরকারের কাছ থেকে ‘‘কর ছাড় সুবিধাও’’ দেওয়ার কথা আদানির।
কিন্তু আদানি পাওয়ার তা করেনি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ও ২২ অক্টোবর বিপিডিবির পক্ষ থেকে আদানির কাছে দুই দফায় চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া সুবিধার বিপরীতে বাংলাদেশে সরবরাহ করা বিদ্যুতের দামে সমন্বয়ের আহ্বান জানানো হয়। এসব চুক্তি এবং চিঠি সবার জন্য উন্মুক্ত না হলেও রয়টার্স দেখেছে বলে জানিয়েছে।
কর্মকর্তারা বলেছেন, ভারত সরকারের কাছ থেকে যে করছাড় পেয়েছে আদানি পাওয়ার, সে অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম ধরা হলে বাংলাদেশের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে প্রায় শূন্য দশমিক ৩৫ সেন্ট সাশ্রয় হবে বলে বিপিডিবির ধারণা। গড্ডা প্ল্যান্ট থেকে কেনা বিদ্যুতের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি সারসংক্ষেপ দেখেছে রয়টার্স। সারসংক্ষেপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত গড্ডা প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশে ৮ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। কর ছাড়ের বিষয়টি সমন্বয় করা হলে এই বিদ্যুতে বাংলাদেশের প্রায় ২৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হতো।
২০১৭ সালের চুক্তিতে গড়ে দুটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। মূলত বিদ্যুতের শুল্ক নির্ধারণ করা নিয়েই এখন উভয়পক্ষের মাঝে বিরোধ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেনার সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, গড্ডা থেকে বাংলাদেশে সরবরাহ করা প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের যে মূল্য ধরা হয়, তা ভারত থেকে ঢাকায় বিক্রি হওয়া সব বিদ্যুতের গড়ের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি।বিপিডিবির তিনটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, গত বছর চুক্তির একটি সূচকে সংশোধনী আনার পর এখন দাম কমানোর জন্য অন্যান্য মানদণ্ড ব্যবহারে আদানি পাওয়ারকে চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশ। এসব মানদণ্ড অনুসরণ করা হলে বিদ্যুতের দাম কমে যাবে। ওই তিন সূত্রের একজন বলেছেন, আদানি পাওয়ার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। শিগগিরই উভয়পক্ষ বৈঠকে বসবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
চুক্তি নিয়ে সিঙ্গাপুরে সালিশি করার শর্ত থাকলেও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, আদালতের নির্দেশে শুরু হওয়া তদন্তের ফলাফলের ওপর বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করবে। তিনি বলেন, তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় যে, চুক্তিতে ঘুষ বা অনিয়ম হয়েছে, তাহলে বাতিলের ক্ষেত্রে আমাদের আদালতের আদেশ অনুসরণ করতে হবে।
বাংলাস্কুপ/ ডেস্ক/এনআইএন/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স