নিয়াজ মোরশেদ
হাল ফ্যাশনে অনেক পরিবর্তন এলেও বিয়ের শাড়ি হিসেবে অনেকেরই প্রথম পছন্দ লাল বেনারসি। বাহারি সাজসজ্জার সাথে কারুকার্যখচিত বেনারসি রমনীকে আকর্ষণীয় করে তোলে। গান, কবিতা বা উপন্যাসেও ঐতিহ্যবাহী এই শাড়ি নিয়ে বাঙালির আবেগ বোঝা যায়। সাতকাহনে সমরেশ মজুমদারের লিখেছেন, 'ভালবাসা হল বেনারসি শাড়ির মত, ন্যাপথালিন দিয়ে যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখতে হয়'।
চলুন জেনে নিই বেনারসি শিল্পের ইতিহাস এবং কেমন আছেন ঐতিহ্যবাহী এই শাড়ির কারিগররা।
বেনারসির যাত্রা শুরু প্রায় পাঁচ শ বছর আগে ভারতের বেনারসে। মোগল সাম্রাজ্য থেকে পথচলা শুরু হয় বাহারি নক্সার এই শাড়ির। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে রেশম ও অলংকরণের বেশির ভাগ উপাদানের আকস্মিক দাম বাড়ে। তাঁতিরা অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে মুক্তির আশায় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। ইংরেজ শাসনামলে ৩৭০টি মুসলিম তাঁতি পরিবার পূর্ব বাংলায় জীবন গড়তে আসেন।
বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে তারা বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজ ধরে রাখে। তাদের হাত ধরেই ঢাকাই বেনারসির যাত্রা শুরু। গুণগত মান আর চাকচিক্যময় ডিজাইনে একসময় বেনারসকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল ঢাকাই বেনারসি। সেসময়ে এই শাড়িকে কেন্দ্র করেই রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন সংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠে বেনারসি পল্লী। পল্লীর পুরো এলাকার এক অংশে তাঁতিদের বসবাস, কারখানা; আরেক অংশে শোরুম।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের পরও তাদের ভাগ্যের চাকায় গতি ফেরে না। বেনারসি শিল্পী সম্প্রদায় তবুও পেশা হিসেবে বেনারসি শাড়ি তৈরি ও কারুকাজে সংগ্রামী অবস্থান ধরে রাখে।
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে কিছু বাংলাদেশি ভালো আয়-রোজগারের আশায় বেনারসি শাড়ি তৈরি ও বিপননের কাজ শুরু করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সকলের প্রচেষ্টায় ঢাকাই বেনারসি শিল্পররূপ পেতে শুরু করে। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বেনারসির বাণিজ্যিক নাম বিস্তৃত হতে থাকে। নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত ঢাকাই বেনারসি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি ধরে রাখে। বাজারে তৈরি হয় ব্যাপক চাহিদা। তবে ফিকে হয়ে আসছে ঢাকাই বেনারসির চাকচিক্য। ভারতীয় শাড়ির দৌরাত্ম্য, কারিগরের অভাব ও উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে কয়েক দশক রাজত্ব করা দেশীয় বেনারসি শিল্প এখন ধুকছে।
বেনারসি শাড়ির উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, ভারতীয় শাড়ির প্রভাবে দেশীয় শাড়ির উৎপাদন ও বিপণন; দুটোই কমেছে। একসময় বেনারসি শাড়ি তৈরিতে কাজ করতো লাখের উপর কর্মী। সেখানে এখন কর্মরত রয়েছেন মাত্র হাজার তিনেক।
স্থানের অভাবও উৎপাদন কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ। ১৯৯৫ সালে সরকারিভাবে ভাষাণটেকে তাতীদের জন্য জমি বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু সেই জমি যেন সোনার হরিণ!
জানা যায়, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড ভাষানটেকের পল্লির কাজ শুরু করে ১৯৯৫ সালে। এ জন্য ৪০ একর জমিও বরাদ্দ দেওয়া হয়। ব্যয় ধরা হয় ২৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বরাদ্দ হয় ২৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
প্রকল্প এলাকায় আগে থেকেই অবৈধ বস্তি ছিল। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম দখলদার বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু উচ্ছেদ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে পাঁচ ব্যক্তি রিট করেন, যা ২০০৩ সালে খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। ফের বস্তি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হলে তা ঠেকাতে আরেকটি রিট করেন একজন বস্তিবাসী। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালে থেকে বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট। এরপর প্রকল্পের কাজ এগোয়নি
তাঁত মালিক মোহাম্মদ জসিম বলেন, দিবে দিচ্ছি করে করে আজ পর্যন্ত ভাষাণটেকের জমি দেওয়া হচ্ছে না। জায়গার আশায় থেকে থেকে অনেক তাঁতী দুনিয়া থেকে চলেও গেছে। ব্যবসা করবে বলে মেশিন খুলে অনেকে ঘরে রেখে দিয়েছেন, কিন্তু জায়গার অভাবে করতে পারছেন না।
বিক্রেতা মোহাম্মদ আফসার জানান,অনেকে রিক্সা চালায়, কেউ শাড়ি বেচে, ঘুরে ঘুরে কাপড় বেচতেছে। এই পেশার উপর ত্যক্ত হয়ে অনেক ধরনের ব্যবসায় তারা লিপ্ত আছে।
কারিগরের অভাবেও ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছে বেনারসি তৈরির কারখানাগুলো। এছাড়াও বেনারসি শাড়ি বুনতে যে সিল্কের জরি বা সুতা ব্যবহার করা হয় তা চীন থেকে আমদানি করতে হয়। বর্তমানে সেই সিল্ক সুতার দাম বাড়ায় শাড়ি তৈরিতেও খরচ বেড়েছে। ফলে একই মানের ভারতীয় বেনারসি থেকে দেশীয় বেনারসির দাম অনেক বেশি পড়ছে।
কারিগররা বলছেন, দেশে এখন সব জায়গায় ভারতের শাড়ি পাওয়া যায়। ওই শাড়িগুলো মেশিনে বানানো হয়, সেকারণে দামও কম। কিন্তু আমরা তো হাতে বানাই, পরিশ্রম বেশি। তাই দামটাও একটু বেশি।
মেশিনে একজন কারিগর সপ্তাহে তিনটি শাড়ি বানাতে পারে। আর সেখানে হাতে বুনলে একটি শাড়ি তৈরিতে সময় লাগে ৭ থেকে ১০ দিন। অল্প সময় ও খরচে অধিক শাড়ি বানানো সম্ভব বলে ভারতের শাড়িগুলো দামে কম। আর এসব শাড়ির বড় মার্কেটই ধরা হয় বাংলাদেশকে।
দেশীয় এবং ভারতীয় শাড়ির মধ্যে দামের পার্থক্য ২ থেকে ৩ হাজার। মেশিনে বোনা ভারতীয় বেনারসি শাড়িগুলো দেখতে উজ্জ্বল, ডিজাইন মসৃণ এবং দাম কম হওয়ায় ক্রেতাদের এর প্রতি আগ্রহ বেশি। তবে মেশিনে বানানোর চাইতে হাতে বানানো শাড়ির মান ভালো বলে দাবি কারিগরদের।
আধুনিক যন্ত্রযুগ এবং সস্তা সিল্কের তৈরি কৃত্রিম শাড়ির কারণে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মিরপুরের বেনারসির উজ্জ্বল সূর্য আজ প্রায় অস্তমিত! ঢাকাই বেনারসির স্বর্ণালি দিন ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
হানিফ সিল্কের এক সত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ আসিফ বলেন, বাইরের থেকে বর্তমানে প্রচুর পরিমান আমদানি হওয়ার কারণে দেশী যে বেনারসি তার চাহিদা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। দেশের পণ্য আপনারা যত বেশি ক্রয় করবেন, তত আমাদের লাভ হবে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
বেনারসি ব্যবসায়ী গনি সওদাগর বলেন, বেনারসে যে শাড়ি তৈরি হয় ওগুলো এখন মেশিনে তৈরি হয়। আমাদের এখানে এখনও হ্যান্ডলুম তাঁত চলছে। এতে মজুরি অনেক বেশি পড়ে যায়। এই জন্য এখানকার মাল আমরা ঠিকমত বাজারজাত করতে পারছি না। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যাংক লোনের কথা বলেন গণি সওদাগর। তিনি বলেন, টা ব্যাংক থেকে লোন পেলে মেশিন আনব। কমখরচে শাড়ি তৈরি করব। কাস্টমার শাড়ি চায়, তবে তা কম দামে চায়।
ঢাকাই বেনারসির সুদিন কি ফিরবে?
বাংলাস্কুপ/বিশেষ প্রতিবেদক/ এনএম/এসকে
ভিডিও প্রতিবেদন :
youtube.com/watch?v=wBKJjkzmrRs&t=3s