ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ , ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​সুখবর দিচ্ছে ‘কারাহ মডেল’ : আলু চাষে আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ০৫-১২-২০২৪ ০৫:১৮:৩০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৫-১২-২০২৪ ০৫:১৮:৩০ অপরাহ্ন
​সুখবর দিচ্ছে ‘কারাহ মডেল’ : আলু চাষে আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
আলু বিশ্বের অন্যতম প্রধান ফসল। উৎপাদনের দিক থেকে ধান, গম ও ভুট্টার পরেই চতুর্থ স্থানে আছে আলু। বাংলাদেশেও আলু একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। সাধারণত দেশের সর্বত্রই এর চাষ হয়ে থাকে। অনুকূল আবহাওয়া ও বাজারজাতকরণের জন্য কিছু জেলায় এর চাষ ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুষ্টি ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
তবে আলু চাষে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে লেট ব্লাইট বা মড়ক রোগ। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছত্রাক ঘটিত এ মড়ক রোগের কারণে প্রতিবছর দেশে উৎপাদিত আলুর প্রায় ২৫ থেকে ৫০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা।
এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ‘কারাহ মডেল’ নিয়ে একটি যুগান্তকারী গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। গবেষণার মাধ্যমে এ মডেলের কার্যকারিতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। যা দেশের আলু চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়। ২০২৩ সালে দেশে মোট আলু উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন। শুধু খাদ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, উচ্চমানের শ্বেতসার, ভিটামিন সি, পটাসিয়াম এবং আঁশের চমৎকার উৎস আলু।
তবে লেট ব্লাইট রোগ আলু চাষে সবচেয়ে বড় বাধা। এ রোগের আক্রমণে প্রথমে গাছের গোড়ার দিকের পাতায় ছোপ ছোপ ভেজা হালকা সবুজ গোলাকার বা বিভিন্ন আকারের দাগ দেখা যায়, যা দ্রুত কালো রং ধারণ করে এবং পাতা পচে যায়। সকাল বেলা মাঠে গেলে আক্রান্ত পাতার নিচে সাদা পাউডারের মত জীবাণু দেখা যায়।
ঠান্ডা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আক্রান্ত গাছ দ্রুত পচে যায়। এই অবস্থায় ২-৩ দিনের মধ্যেই ক্ষেতের সমস্ত গাছ মরে যেতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত আলুর গায়ে বাদামি থেকে কালচে দাগ পড়ে এবং খাবার অযোগ্য হয়ে যায়।
মড়ক দমনে কৃষকরা সাধারণত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেন। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় ছত্রাকনাশক প্রয়োগের অভাবে একদিকে খরচ বেড়ে যায়, অন্যদিকে মাটির গুণাগুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সমস্যা সমাধানে কারাহ মডেল হতে পারে একটি কার্যকর ও সাশ্রয়ী সমাধান।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই মডেল ব্যবহার করে মাত্র ছয়বার ছত্রাকনাশক প্রয়োগের মাধ্যমেই মড়ক রোগ দমন করা সম্ভব, যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে ১২ থেকে ১৬ বার ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হয়। ফলে রোগমুক্ত বীজ আলু উৎপাদন নিশ্চিত হয়েছে, উৎপাদন খরচ কমেছে এবং ২৫-৩০ শতাংশ বেশি উৎপাদন পাওয়া গেছে।
২০১৯ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়া ব্লাইট নেটওয়ার্কের এক আলোচনা সভায় অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম বেলজিয়াম উদ্ভাবিত কারাহ মডেলের সঙ্গে পরিচিত হন। এটি মূলত আবহাওয়া নির্ভর একটি পূর্বাভাস পদ্ধতি, যা একটি আবহাওয়া স্টেশনের মাধ্যমে মড়ক রোগ প্রতিরোধে ছত্রাকনাশক প্রয়োগের সঠিক সময় নির্ধারণ করে।
চীনের উচ্চপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বেইজিং হুইসি জুন্ডা টেকনোলজি কোম্পানি কারাহ মডেলটির জন্য অত্যাধুনিক “এইচএসজেডি স্টেশন” নকশা ও নির্মাণ করে। ছোট এ স্টেশন জমির তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার মতো তথ্য সংগ্রহ করে এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কৃষককে পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা প্রদান করে। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে অ্যাপেক্স এগ্রিসায়েন্স লিমিটেডের অর্থায়নে গোবিন্দগঞ্জে একটি এইচএসজেডি স্টেশন স্থাপন করে গবেষণা শুরু করেন অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম।
গত জুন মাসে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড পটেটো কংগ্রেস-২০২৪ এ অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারাহ মডেলের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ক ওই গবেষণার একটি সেমিনার পেপার উপস্থাপন করেন। তার গবেষণার প্রাথমিক সাফল্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ১৮০টি আবহাওয়া স্টেশন স্থাপনের জন্য চায়না ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সির (সিআইডিসিএ) মাধ্যমে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়নের একটি প্রকল্প বিবেচনাধীন রয়েছে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম বলেন, “আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক সময়ে সঠিক ছত্রাকনাশক প্রয়োগের ফলে আলুর মড়ক রোগ শতভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে এসেছে এবং লাভ বেড়েছে।”তিনি বলেন, “কারাহ মডেল ইতোমধ্যে চীন ও বেলজিয়ামে সফলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। চীনে এটি বর্তমানে মড়ক দমনে ‘ন্যাশনাল রেফারেন্স’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও এটি টেকসই কৃষি প্রযুক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষক দলটির পরিকল্পনা রয়েছে দেশের ১৫টি আলু উৎপাদনকারী জেলায় অন্তত ২ থেকে ৩ টি করে আবহাওয়া স্টেশন স্থাপন করার। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি রাসায়নিক ছত্রাকনাশকের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে জৈবিক ছত্রাকনাশকের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যেও কাজ চলছে।”
কারাহ মডেলের ভবিষ্যত সম্ভাবনা নিয়ে গবেষক বলেন, “আমাদের লক্ষ্য মড়ক রোগ দমনে প্রযুক্তি নির্ভর সমাধান নিশ্চিত করা এবং রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে আলু উৎপাদনকে সাশ্রয়ী ও টেকসই করা। কারাহ মডেল শুধু আলু চাষে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি ভবিষ্যতে অন্যান্য ফসল চাষেও প্রযোজ্য হতে পারে। প্রযুক্তি-নির্ভর এ উদ্যোগ দেশের কৃষি খাতের চিরচেনা বাস্তবতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করছি।”

বাংলা স্কুপ/ প্রতিবেদক/ এনআইএন/এসকে 


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ