ঢাকা , বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪ , ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​অস্থিরতায় স্থবির রাজধানী

আন্দোলন, সড়ক অবরোধ, ঘেরাও কর্মসূচি, সংঘর্ষ, যানজট লেগেই আছে

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ২৬-১১-২০২৪ ১২:১৩:২০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২৬-১১-২০২৪ ০২:২১:১৩ অপরাহ্ন
আন্দোলন, সড়ক অবরোধ, ঘেরাও কর্মসূচি, সংঘর্ষ, যানজট লেগেই আছে ​ফাইল ফটো
নিয়মিত আন্দোলন, সড়ক অবরোধ, সচিবালয় ঘেরাও এবং নানা দাবিতে শিক্ষার্থীদের সড়কে নামা যেন এখন রোজকার ঘটনা। যার ফলাফল অস্থিরতা বেড়েই চলেছে শিক্ষাঙ্গনে। অশান্ত হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। অব্যাহত নানা ছাত্র আন্দোলন আর সংঘর্ষের মুখে অচল হয়ে পড়েছে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীদের আরও বিনয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রদের অন্যায্য দাবির কাছে সরকার মাথানত করায় দেশে এমন পরিস্থিতি।  চলমান এই সংঘাতের পেছনে অবশ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।  
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলে সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনেই চলছে অস্থিরতা। সবশেষ রোববার থেকে তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় হতবাক দেশবাসী। দিন পেরিয়ে রাত-তবুও শেষ হয়নি সংঘর্ষ। আর সেই তাণ্ডবের পাল্টা তাণ্ডব চলে সোমবার দিনভর। যা রীতিমতো দেশবাসীকে হতবাক করছে। 
ছাত্রদের নানা অন্যায্য দাবির কাছে মাথা নত করেছে সরকার এমন মন্তব্য করে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। তিনি বলেন, ছাত্রদের উচিত ছিল পড়াশোনায় ফিরে যাওযা। কিন্তু পড়াশোনায় ফিরে না গিয়ে ছাত্রদের একটি অংশ রাজনীতি বা রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহী হয়েছেন। ছাত্রদের অন্যায্য দাবির কাছে সরকারের নতি স্বীকার করা ঠিক হয়নি। দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের আরও বিনয়ী হওয়া প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। 
তিলোত্তমা ঢাকা, এসব উক্তি এখন ছবির ফ্রেমে বাঁধা। যানজটের এ নগর কর্মব্যস্ত মানুষের অনুভূতিতে অস্বস্তির এক নাম। সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংঘাত, সহিংসতা ও নিরাপত্তাহিনতার ফিরিস্তি। কথা নেই, বলা নেই- হঠাৎ উৎকণ্ঠার ছাপ এসে ভর করেছে নগরবাসীর জীবনে। কখন কোথায় কি ঘটবে তা জানা নেই কারও। ছোটখাটো ঘটনা নিয়েই তৈরি হচ্ছে সংঘাত কিংবা সহিংসতা। দাবি আদায়ের মতো স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠছে সহিংস। কোনোভাবেই অস্বাভাবিক এসব ঘটনার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। 
৫ আগস্টের পর যেন স্থায়ীভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছে না ঢাকা। যে কোনো ইস্যু নিয়েই হচ্ছে আন্দোলন। কখনো আনসার, কখনো রিকশাচালক, কখনো গার্মেন্ট শ্রমিক আবার কখনো চাকরিতে ৩৫ বয়স প্রত্যাশীরা রাস্তায় নেমে পড়েছেন। সে ঘটনা রূপ নিচ্ছে সংঘাতে। বাসে ওঠা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার জেরে গত ২০ নভেম্বর রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় সংঘর্ষে জড়ান ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। কার্যত অচল হয়ে পড়ে পুরো রাজধানীর সড়কপথ। এর ঠিক দুদিন আগেই সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে রেললাইন অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। ব্যাহত হয় রেল যোগাযোগ। এ ছাড়া গত ২১ নভেম্বর হলের সিট বরাদ্দের জেরে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অচল হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। ঢাকা ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজকে ঘিরে রণক্ষেত্র তৈরি হয়েছে যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া এলাকা। এসব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
অক্টোবরে এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। এতে অন্তত ১৫ জন আহত হন, যার অধিকাংশই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী। যদিও শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে কথা কাটাকাটির দাবি করলেও এই ঘটনার নেপথ্যেও ছিল আইডিয়ালের এক মেয়ে শিক্ষার্থীর হেনস্থার বিষয়। এতে আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাসে হামলা চালায়। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা আইডিয়াল কলেজে পাল্টা হামলা করে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যায়। মাত্র একদিন আগে বুটেক্সের আজিজ হল ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের লতিফ হলের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়, ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। 
কয়েক দিন ধরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক ও মালিকরা বিভিন্ন দাবি আদায়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ও সমাবেশ করছে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে যায় তারা। পরে পুলিশ প্রশাসনের আশ্বাসে গণঅবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়ন। 
জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশ। দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে সহস্রাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গত ৫ আগস্ট আন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রচিত হয় এক নতুন বাংলাদেশ। তবে এর কিছু দিন পর থেকে বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনের নামে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছেন আন্দোলনকারীরা। ঢাকায় কখন কোন রাস্তা বন্ধ হবে কিংবা কারা কখন কোন রাস্তা বন্ধ করে দিবে- সেটিই এখন বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নগরবাসীর জন্য। 
রাস্তাঘাট বন্ধ করার এসব ঘটনাকে অন্যদের জিম্মি করে দাবি আদায় কিংবা চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা, যার ফলে নির্বিঘ্নে যানবাহন ও জনচলাচল মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, এর লাগাম টেনে ধরা জরুরি। জনচলাচল ও স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড নিয়ে জনমনে যে ভীতি তৈরি হয়েছে তা দূর করতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হওয়া উচিত। একই সাথে কারও যৌক্তিক দাবি থাকলে তা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় আলোচনা করে সমাধান করা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলছেন, কেউ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন আবার কেউ ভুল বুঝাবুঝির সূত্র ধরে অস্থিরতায় জড়িয়ে পড়ছেন। সব মিলিয়ে মানুষের ভোগান্তির ঘটনা বাড়ছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এগুলো হচ্ছে। আর এগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া। মানুষকে খোঁজ নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে যে তিনি ঠিকমতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন কি না। তিনি আরও বলেন, অনেকে অধিকারের কথা বলতে এসেও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছেন। এমনকি হাসপাতাল পর্যন্ত ভাঙচুর হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে অন্যকে বাধা না দিলে দাবি আদায় হয় না- এমন ধারণা পোষণ করছেন অনেকে। অন্যদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের কৌশল এটি। তাই সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হওয়া দরকার। আবার কারও যৌক্তিক দাবি থাকলে সেটি একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়নের দৃশ্যমান উদ্যোগ থাকা দরকার।  
 
 
বাংলা স্কুপ/ প্রতিবেদক/ এনআইএন/এসকে 
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ