ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ , ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খুললেন মঈন ইউ আহমেদ, সুষ্ঠু তদন্তের দাবি

আপলোড সময় : ০৭-০৯-২০২৪ ১২:৩৯:২৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৭-০৯-২০২৪ ০২:১২:১৩ অপরাহ্ন
পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খুললেন মঈন ইউ আহমেদ, সুষ্ঠু তদন্তের দাবি ​মঈন ইউ আহমেদ। ছবি : ইউটিউবের ভিডিও থেকে
বাংলা স্কুপ, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪: 
রাজধানীর পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে ঘটেছিল দেশের ইতিহাসের নৃশংস এক হত্যাকাণ্ড। বিডিআরের বিদ্রোহে ওই সময় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পিলখানা ট্র্যাজেডি নিয়ে মুখ খুলেছেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ।  তিনি বলেছেন, হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে ১৫ বছরে শুধু বিগত সরকারের কথা শুনতে হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা অনেক কিছুই জানা নেই। জনগণও জানতে পারেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থানরত মঈন ইউ আহমেদ বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) তাঁর নিজের ইউটিউব চ্যানেলে নিজের ভাষ্য তুলে ধরেন।  তিনি ‘মইন আহমেদ’ নামের ইউটিউব চ্যানেলটি ২৫ আগস্ট খুলেছেন।

সেখানে ২৯ মিনিটের ভিডিও বার্তার শুরুতেই ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে নিহতদের মাগফেরাত ও আহতদের দ্রুত সুস্থ কামনা এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রার্থনা সরকার ও ছাত্র-জনতা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয় বলে মন্তব্য করেন সাবেক সেনাপ্রধান।

সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর বিডিআর বিদ্রোহের কিছু প্রত্যক্ষদর্শী ও পরিবারের সদস্যরা তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। আমিও আমার ভূমিকা তুলে ধরতে চাই।’ 

মঈন ইউ আহমেদ বলেন, গত ১৫ বছর ধরে আমরা শুধু বিগত সরকারের কথা শুনে গেছি। প্রকৃত ঘটনার অনেক কিছুই আমাদের জানা নেই। সরকার এ ব্যাপারে একটি তদন্ত আদালত গঠন করে এবং সেনাবাহিনীও একটি তদন্ত আদালত গঠন করে।
 
তিনি বলেন, বিডিআর বিদ্রোহ ঘটনার আমি যখন তদন্ত আদালতের নির্দেশ দিই, তখন আমাকে বলা হলো সরকার যখন এ বিষয়ে তদন্ত আদালত করছে, তখন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এর প্রয়োজনটা কী? এই তদন্ত আদালত করতে সরকারের কাছ থেকে যে সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন তা আমরা পাইনি।

সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, সেনাবাহিনীর তদন্ত আদালতের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গির আলাম চৌধুরী (বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা)। তিনি তার কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারেননি। কারণ, জড়িতদের অনেকে জেলে ছিল, অনেককে প্রশ্ন করা সম্ভব হয়নি। সেনাবাহিনীর তদন্ত আদালত চলাকালীন জেনারেল জাহাঙ্গির আমার কাছে এসে বেশ কয়েকবার তাঁর সমস্যার কথা তুলে ধরেন। আমি আশা করি, তিনি এখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হয়েছেন। তিনি এই তদন্ত কমিটি পুনর্গঠিত করে জড়িতদের বের করতে সক্ষম হবেন। আমি সরকার গঠনের পর তাঁকে এই বিষয়ে অনুরোধ করেছি।

ভিডিওতে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন মঈন ইউ আহমেদ। এসময় বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে তার লেখা বই খুব শিগগির প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।

কী ঘটেছিল সেদিন পিলখানায়?
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে মঈন ইউ আহমেদ বলেন, সেদিন (২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে সাড়ে ৭টায় সেনাসদরের প্রতিদিনের মতো কাজ শুরু হয়। সকালে আমি সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় সিজিএস লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিনহা ইবনে জামালি আমার কাছে এসে বলেন, আমাদের কাছে কিছু মর্টার আছে, যা সেনাবাহিনী ব্যবহার করে না। এর গুদামজাত এবং রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের জন্য কঠিন। তবে বিডিআর এগুলো ব্যবহার করে। এগুলো তারা নিয়ে গেলে আমাদের উপকার হবে।’

তিনি বলেন, ‘এরপর আমি বিডিআরের ডিজির জেনারেল শাকিলের সঙ্গে কথা বললে তিনি এগুলো নিতে রাজি হন। আমার বিশ্বাস তিনি তখন পর্যন্ত এই বিদ্রোহ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এরপর আমি আর সিজিএস মিটিংয়ের জন্য যাই। ৯টায় সেই মিটিং শুরু হয়। আমরা সবাই তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ি সেখানে। সাড়ে ৯টার দিকে আমার প্রিন্সিপল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ রুমে প্রবেশ করেন এবং আমাকে বলেন, পিলখানায় গণ্ডগোল হচ্ছে। আপনার দিক-নির্দেশনা প্রয়োজন। কিছুক্ষণ পর আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের ফোন ব্যস্ত পাই।’

মইন ইউ আহমেদ বলেন, ‘সামরিক গোয়েন্দারা তখন আমাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানায়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আমি তখন সময় বাঁচাতে কারও নির্দেশ ছাড়া সেনাবাহিনীর আরেকটি ব্রিগেডকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেই। তারা তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে যার নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন রেস্টোর অর্ডার’।

তিনি বলেন, ‘৯টা ৪৭ মিনিটে ডিজি বিডিআরকে (শাকিল) ফোনে পাওয়া যায়। তিনি আমাকে বলেন, ‘দরবার চলাকালীন দুইজন সশস্ত্র সৈনিক প্রবেশ করে একজন আমার পেছনে দাঁড়ায়। এরপরই বাইরে থেকে গুলির শব্দ আসে। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে থাকা সৈনিকরা দরবার হল থেকে বের হয়ে যায়। এগুলো সবই মনে হয় প্ল্যান করা এবং প্ল্যান অনুযায়ী সব চলছে। আমি সেক্টর কমান্ডার এবং ব্যাটালিয়ান কমান্ডারদের পাঠিয়েছি তাদের ফেরত আনার জন্য।’ তখন আমি তাকে অপারেশনের কথা জানাই।

মইন ইউ আহমেদ আরও বলেন, ৯টা ৫৪ মিনিটে আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। এর মধ্যেই তিনি বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গেছিলেন। এ সময় আমি তাকে অপারেশনের কথা জানালে তিনি জানতে চান, কতক্ষণ সময় লাগবে এই ব্রিগেডকে তৈরি করতে? আমি সময় জানিয়ে ব্রিগেডকে পিলখানায় যাওয়ার জন্য তার অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় লাগলেও ৪৬ ব্রিগেড এক ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা শুরু করে।

‘এদিকে বিদ্রোহীরা বিডিআর গেটগুলোর সামনে আক্রমণ প্রতিহত করতে রকেট লাঞ্চার, মর্টারসহ অন্যান্য অস্ত্র মোতায়েন করে। বেলা ১১টায় ৪৬ ব্রিগেডের প্রথম গাড়িটি মেইন গেটের কাছাকাছি পৌঁছালে বিদ্রোহীরা একটি পিকআপ লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায়। এতে চালক ঘটনাস্থলেই মারা যান। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসের ধারণা অনুযায়ী, সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যেই ডিজি, ডিডিজি, কর্নেল আনিস, কর্নেল কায়সারসহ অনেক অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমাদের টিম পৌঁছায় ১১টার পরে।’

বিদ্রোহের বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের লাইভ কাভারেজের সমালোচনা করে তৎকালীন সেনাপ্রধান বলেন, ঘটনার সময়ে গণমাধ্যমে চলা লাইভ কাভারেজ বিডিআর বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিতে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।

সাবেক সেনাপ্রধান জানান, ক্যাপ্টেন শফিক তার নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র‍্যাব সদস্য নিয়ে পিলখানায় পৌঁছান ১০টার আগেই। এ সময় তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পিলখানায় প্রবেশের অনুমতি চাইলেও তিনি তা পাননি। তিনি অনুমতি পেলে হয়তো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সুবিধা হতো এবং এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।

মঈন বলেন, ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে পিএসও এএফডি জানায়, সরকার রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, কোনও আলোচনার আগে সেনাবাহিনীকে এই এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। তাদের সঙ্গে সমঝোতা না হলে তখন সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে। বেলা ১২টায় তিনি আমাকে ফোন করে জরুরিভিত্তিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যমুনায় দেখা করতে বলেন। বেলা ১টার দিকে সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজম আলোচনার জন্য পিলখানায় যান।

তিনি আরও বলেন, আমি যমুনায় যাওয়ারও ঘণ্টাখানেক পর বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধান সেখানে আসেন। অর্থাৎ তাদের আমার পরে ফোন করে আসতে বলা হয়েছে। অনেকক্ষণ পর তারা সেখানে এলে আমাদের জানানো হয়, সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজম বিদ্রোহীদের একটি দল নিয়ে যমুনাতে আসছেন এবং তারা (বিদ্রোহীরা) সাধারণ ক্ষমা চায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) বলেন, বিদ্রোহীদের কিছু বলার থাকলে আমরা যেন তাদের বলি। তখন আমি তাকে বলি, অনেকে নিহত হয়েছেন। তাদের কোনও দাবি মানা যাবে না। আপনি তাদের বলবেন প্রথমত, অফিসার হত্যা এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের সবাইকে এখনই মুক্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, অস্ত্রসহ বিদ্রোহীদের আত্মসমপর্ণ করতে হবে এবং চতুর্থত, সাধারণ ক্ষমা দেওয়ার প্রশ্নই নেই।’

ডেস্ক/এসকে





 
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ