ঢাকা , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ , ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

১৭ বছরেও ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্তরা

সিডরের ভয়াল স্মৃতি তাড়া করে উপকূলবাসীকে

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ১৫-১১-২০২৪ ০২:২১:১২ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ১৫-১১-২০২৪ ০২:২১:১২ অপরাহ্ন
সিডরের ভয়াল স্মৃতি তাড়া করে উপকূলবাসীকে
আজ ভয়াল ১৫ নভেম্বর। ২০০৭ সালের এই দিনে দেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। ওই সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর ও ঝালকাঠি জেলা। তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রায় ৩১ জেলায়। এতে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৭ বছর পরেও সেই প্রলয়ংকারী তাণ্ডবলীলার কথা মনে করে এখনও আতকে ওঠেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। 

স্বজন হারানোর বেদনায় আজও কাঁদেন উপকূলবাসী। ওইদিন উপকূলের লাখো মানুষ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল। স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। সিডরের তাণ্ডবে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয় দেশের দুই শতাধিক উপজেলা। বিধ্বস্ত হয় ৬ লাখ মানুষের বসতবাড়ি, ফসলের ক্ষেত। ভয়াবহ বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সড়ক, নৌ, বিদ্যুৎ এবং টেলিযোগাযোগসহ নানা অবকাঠামো। 

বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার জাকির হোসেন তুলে ধরেন তার ক্ষত-বিক্ষত অবস্থার কথা। তিনি বলেন,‘সিডরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘর-বাড়িসহ সহায়-সম্পদ সব তছনছ হয়ে গিয়েছিল। ভাসিয়ে নিয়েছিল বাবাকে। পরে লাশ পাওয়া যায়। ভাইয়ের ছেলেও সিডরের আঘাতে মারা যায়। ১৭ বছর ধরে সংগ্রাম করে চলছি। কিন্তু আগের সেই অবস্থা এখনও ফেরাতে পারিনি। ভেঙে যাওয়া ঘরের মতো ঘর আর বানাতে পারিনি। সিডরের সময়ের চেয়ে এখনের ঘরটি আরও খারাপ অবস্থা। যাদের হারিয়েছি তাদের তো ফিরে পাওয়ার সুযোগ নেই। এই ১৫ নভেম্বর এলে বাবার জন্য হাহাকার বেড়ে যায়। ১৭ বছরের মধ্যে কত জনপ্রতিনিধি এলো। কিন্তু আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি।’ তিনি বলেন, এলাকার মানুষের ভালোবাসায় জনপ্রতিনিধি হয়ে নিজে একটু ভালো থাকতে পারলেও সিডরের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেননি। 

সাউথখালীর ক্ষতিগ্রস্ত অন্যদের অবস্থা আরও শোচনীয়। বাঁধ নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু নদী শাসন যথাযথ না হওয়ায় সংকট রয়েই গেছে। তিনি জানান, তার মতো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার আছে যারা সব হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেক পরিবার এখনও ঘর-বাড়ি তৈরি করতে পারেনি। আকাশে ঘন মেঘ দেখলে এখনও আঁতকে ওঠেন সাউথখালীর মানুষ।

সিডরের গ্রাসে বাবা-মাসহ পরিবারের ৭ সদস্যকে হারিয়েছিলেন সাউথখালীর বাসিন্দা মো. আল আমিন। সেদিনের সেই ভয়াবহ ঘটনার পর ১৭ বছরেও তিনি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। বলেশ্বর নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছিল তার বসত বাড়িটিও।

আল আমিন বলেন, সিডরের জলোচ্ছ্বাসে সেদিন বাবা, মা, নানী, বোনের মেয়ে, ফুপু এবং দুই ফুপাতো বোনকে হারিয়েছি। সিডরের পর বলেশ্বর নদীর ভাঙনে আমার বাড়ি-ঘর সব চলে গেছে। সিডরের ১৭টি বছর পার হয়েছে, তবুও কষ্ট লাঘব হয়নি। আতঙ্কে থাকি সবসময়।

বরিশালের বাকেরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা জাফর আলী হাওলাদার বলেন, সিডরের সময় যে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছি এবং চারদিকে স্বজন ও গৃহহারা মানুষের যে আর্তনাদ দেখেছি তা কখনো ভুলতে পারব না। 

জানতে চাইলে দুর্যোগপ্রবণ উপজেলা রাঙ্গাবালী প্রেসক্লাবের সভাপতি কামরুল হাসান জানান, উপকূলের মানুষকে সবসময়ই ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। এজন্য উপকূলীয় ১৯টি জেলার মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতা নিয়ে কাজ করতে উপকূলীয় মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি করেন তিনি। 

পটুয়াখালী জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম আরিফ বলেন, সিডর ও সত্তরের ঘূর্নিঝড়ের দুঃসহ স্মৃতি আজও এ অঞ্চলের মানুষকে তাড়া করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্থ উপকূলীয় জেলাসমূহের জন্য কথা বলতে ও কাজ করতে বছরের একটি দিনকে উপকূল দিবস ঘোষণা করা অত্যন্ত জরুরি। এ নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করে যাচ্ছেন বলেও জানান এ সাংবাদিক নেতা। 

যোগাযোগ করা হলে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের প্রতিষ্ঠাতা ডিন অধ্যাপক (অব) আ.ক.ম মোস্তাফা জামান বলেন, বারবার ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানার বিষয়টি মাথায় রেখেই পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আধুনিক শিক্ষা ও পদ্ধতি উপকূলীয় এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়া দুর্যোগে যাতে কম ক্ষয়ক্ষতি হয় সেজন্য সরকারকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। একই সঙ্গে বিশাল উপকূলীয় এলাকার মানুষের সংগ্রামী জীবনযাপন স্মরনে দ্রুত ‘উপকূল দিবস’ ঘোষণাসহ নানা জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

উল্লেখ্য, উপকূলে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হেনেছিল। মুহূর্তের মধ্যে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা ও পটুয়াখালীর উপকূলীয় জনপদ। কিছু বুঝতে পারার আগেই জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়েছিল বাড়ি-ঘর, ফসলের ক্ষেতসহ পথচারীদের। 


বাংলা স্কুপ/ প্রতিনিধি/ এনআইএন/এসকে 
 


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ