এসএসসির খাতা পুনঃনিরীক্ষণ
ফেল থেকে পাস ৪১০, নতুন জিপিএ ৫ পেল ৩৯৪ জন
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
১৪-১১-২০২৪ ০৯:৪৩:০৫ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৪-১১-২০২৪ ০৯:৫৪:২৯ অপরাহ্ন
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে সন্তুষ্ট না হয়ে উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষার চ্যালেঞ্জ করে প্রায় ৩ হাজার ৪৭৫জন পরীক্ষার্থীর ফলাফলে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এদের মধ্যে পূর্বের ফলাফলে অকৃতকার্য হয়েও ৪১০জন শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছেন। আর নতুন করে জিপিএ ৫ পেয়েছেন ৩৯৪ জন।
আগের ফলাফলে অনুত্তীর্ণ থাকা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে খাতা চ্যালেঞ্জের পর সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ ৫ পেয়েছেন ১ জন। বাকি শিক্ষার্থীর বিভিন্ন গ্রেডে ফল পরিবর্তন হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ৯টি সাধারণ এবং মাদ্রাসা বোর্ডের প্রকাশিত পুনঃনিরীক্ষণের ফল বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পুনঃনিরীক্ষণে এবারও রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে বলে বোর্ডগুলো জানিয়েছে। যদিও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা বোর্ড তাদের ফল প্রকাশ করতে পারেনি। সবগুলো বোর্ডের খাতা মূল্যায়নে রেকর্ড পরিবর্তনের এই চিত্রকে উদ্বেগজন বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, বছরের পর বছর শিক্ষা বোর্ডগুলোর অবহেলা এবং শিক্ষকদের উদাসীনতার শিকার হচ্ছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বহু পরীক্ষার্থী। তাদের কারণে প্রতি বছরই হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভুল ফল মূল্যায়নের শিকার হচ্ছেন। প্রথম দফায় অনেকে ফেল বা কম জিপিএ পাচ্ছে, বিপরীতে ফল পুনঃনিরীক্ষায় ফেল থেকে পাস করছে, জিপিএ ৫ পাচ্ছে এমন নজির আছে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব ঘটনার সঙ্গে শিক্ষা বোর্ডগুলোর অসাধু কর্মকর্তা এবং কিছু শিক্ষক জড়িত। পরীক্ষা শেষে খাতা বণ্টনের সময় অনেক ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে থাকেন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তারা। কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষককে অধিক পরিমাণে খাতা দেওয়া হয় আর যোগ্যদের অনেকেই বোর্ডের পরীক্ষক হতে পারেন না। উত্তরপত্র (পরীক্ষার খাতা) মূল্যায়নের জন্য সময় দেওয়া হয় মাত্র দুই সপ্তাহ। এ সময়ের মধ্যে তিনশ’ খাতা ভালোভাবে দেখা সম্ভব; কিন্তু দেওয়া হয় তিনশ’ থেকে সাতশ’ খাতা।
আরও অভিযোগ রয়েছে, সময়ের স্বল্পতার অজুহাতে পরীক্ষকেরা ছাত্র বা পরিবারের সদস্যদের দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করিয়ে থাকেন। নম্বর যোগ করার সময় মনোযোগ দেওয়া হয় না। এতে পরিসংখ্যানগত ভুল বাড়ছে। ফলে পাল্টে যাচ্ছে রেজাল্ট। অমনোযোগিতার কারণে কোনো বিষয়ে নম্বর প্রাপ্ত ৮৬ নম্বর, ৬৮ হিসেবে রেজাল্ট শিটে উঠছে। এতে অনেক শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফল পুনঃনিরীক্ষায় এসব ভুল ধরা পড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ বছর সাতটি বিষয়ের পরীক্ষা হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের যৌক্তিক আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে কয়েক দফায় পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয় সরকার। পরে বাকি পরীক্ষাগুলো বাতিল করে আগের ফলাফলের সাথে ম্যাপিং করে অটোপাস পাস দেওয়া হয়। ওই সময়ের বিষয়ে পরীক্ষা না হওয়ায় খাতা চ্যালেঞ্জের সংখ্যা অনেক কম পড়েছে।
এদিকে বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর ফলাফল পরিবর্তনের পেছনে পরীক্ষকদের সরাসরি গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পুনঃনিরীক্ষণে নতুন করে কোনো উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু উত্তরপত্রে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বরের যোগ-বিয়োগগুলো দেখা হয়। এতেই এতো সংখ্যক শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। যদি আবার মূল্যায়নের সুযোগ দেওয়া হয় তবে পরিস্থিতি কি হবে প্রশ্ন রেখে তারা বলছেন, শুধু পরীক্ষকদের গাফিলতিতে এমনটা হচ্ছে। এ জন্য ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করার রীতিকে দায়ী করছেন তারা।
জানা যায়, ২০১৯ সালে টানা তিন বছর ধারাবাহিক গাফিলতির কারণে ১ হাজার ২৬ পরীক্ষককে শাস্তি দেয় শিক্ষা বোর্ডগুলো। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বোর্ডের আইন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযুক্ত বেশিরভাগ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত, কাউকে সারা জীবনের জন্য কোনো বোর্ডের পরীক্ষক হতে না পারার মতো শাস্তি দেওয়া হয়। তবে যেসব পরীক্ষক খাতা মূল্যায়নে কেলেঙ্কারি বা ক্রাইমে যুক্ত হন, তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ এবং চাকরিচ্যুতির নজির রয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময় তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা হলেও সংখ্যাটা খুবই কম।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর আবুল বাশার বলেন, এবার সাতটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি। ফলে খাতা চ্যালেঞ্জ করে ফল পরিবর্তনের সংখ্যাটা অন্যান্য বছরের চেয়ে কম। তারপরও তা অস্বাভাবিক। এর কারণ খতিয়ে দেখা হবে। ফল পরিবর্তন হবে এটি স্বাভাবিক ঘটনা, তবে এই সংখ্যাটি যদি নির্দিষ্ট পার্সেন্টের বাইরে চলে যায় তবে আমাদের চিন্তার বিষয়। তবে কোনো জায়গায় সমস্যা হচ্ছে কি না, তা চিহ্নিত করতে হবে। তিনি আরও জানান, সব বোর্ডের তথ্য সংগ্রহ করে চিহ্নিত পরীক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অভিযুক্ত বেশিরভাগ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। অপরাধের মাত্রা বেশি হলে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার বিধানও রয়েছে।
গত ১৫ অক্টোবর চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। এতে গড় পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। প্রকাশিত ফলাফলে কোনো শিক্ষার্থী কাঙিক্ষত ফল না পেলে সে খাতা চ্যালেঞ্জ করার জন্য গত ১৬ অক্টোবর থেকে এ আবেদন চলে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত। এরপর বৃহস্পতিবার পুনঃনিরীক্ষণের ফলাফল প্রকাশিত হলো।
কোন বোর্ডে কত জনের ফল পরিবর্তন
ঢাকা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার কাঙিক্ষত ফল না পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার ৬০টি উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করে শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে মোট ১ হাজার ৩৩০ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। এতে নতুন করে জিপিএ ৫ পেয়েছেন পেয়েছে ২০০ জন আর ফেল থেকে পাস করেছেন ১৩৭ জন পরীক্ষার্থী। ফেল থেকে নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন একজন।
আর চট্টগ্রাম বোর্ডে ফলাফল পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করে মোট ২২ হাজার ৩২৪ পরীক্ষার্থীর ৬৮ হাজার ২৭১টি খাতার আবেদন করেন। এর মধ্যে মোট ৫৫৬ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে ফেল থেকে পাস করেছে ১১৯জন এবং নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬১জন।
অন্যদিকে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে এ বছর খাতা পুনঃনিরীক্ষণের জন্য ৭ হাজার ২১ শিক্ষার্থী ২৪ হাজার ২৬৫টি খাতা চ্যালেঞ্জ করেছিলো। সেখান থেকে মোট ৮৯ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯ শিক্ষার্থী আর ফেল থেকে পাস করেছে ১ শিক্ষার্থী।
আর দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডে মোট ১৪ হাজার ৫২৫ পরীক্ষার্থী ৩৭ হাজার ৬৩৯টি খাতা চ্যালেঞ্জ করে। এর মধ্যে মোট ফল পরিবর্তন হয়েছে ৮১ জন শিক্ষার্থীর। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৮ জন, ফেল থেকে নতুন করে পাস করেছেন ১৬ জন।
এ ছাড়া রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ১৫ হাজার ৩৭৮ পরীক্ষার্থী মোট চ্যালেঞ্জ করেন ৩৯ হাজার ২৬৩টি খাতা। এর মধ্যে ফল পরিবর্তন হয়েছে ৯৮ জনের। এর মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৪ জন। ফেল থেকে নতুন করে পাস করেছে ৩৪ জন।
আর যশোর বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার খাতা পুনঃনিরীক্ষণে মোট ৭৯ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৩ জন। আর ফেল থেকে নতুন করে পাস করেছে ৩১ জন। বাকিরা বিভিন্ন গ্রেডের ফল পরিবর্তন হয়েছে।
কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে মোট ২১ হাজার ৬১৪ পরীক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে ৬৫ হাজার ৮৫ উত্তরপত্র চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করে। তাদের মধ্যে ৮১ জনের ফল পরিবর্তন হয়। এর মধ্যে ২১ জন নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ২৪ জন ফেল থেকে পাস করেছেন।
ময়মনসিংহ শিক্ষাবোর্ডে ১৮ হাজার ৬৯৯ পরীক্ষার্থী খাতা চ্যালেঞ্জ করে ৪৬ হাজার ২৪১টি। এর মধ্যে মোট ৮৯ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৭ শিক্ষার্থী। ফেল থেকে পাস করেছে ২৩ শিক্ষার্থী।
সিলেট শিক্ষাবোর্ডে মোট সিলেট শিক্ষা বোর্ডে ৬ হাজার ৩০৬ পরীক্ষার্থী ১০ হাজার ৬৯টি খাতা চ্যালেঞ্জ করে। এর মধ্যে ৩৪ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫ জন। ফেল থেকে পাস করেছে ১৫ জন।
এর বাইরে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আলিম পরীক্ষায় মোট ২ হাজার ৭১৪ পরীক্ষার্থী ৭ হাজার ৮১৪টি খাতা চ্যালেঞ্জ করেন। তাদের মধ্যে মোট ৩৬ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। ফেল থেকে পাস করেছে ১০ জন শিক্ষার্থী, আর নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬ জন পরীক্ষার্থী।
বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স