ঢাকা , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ , ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​বিদ্যুৎকর্মীর মৃত্যুর দায় কার?

আপলোড সময় : ২৪-১০-২০২৪ ০৪:৪৬:১৫ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২৪-১০-২০২৪ ০৪:৪৯:০১ অপরাহ্ন
​বিদ্যুৎকর্মীর মৃত্যুর দায় কার? গ্রাফিক্স। বাংলা স্কুপ
রাজধানীতে সঞ্চালন লাইনে কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক বিদ্যুৎকর্মী নিহত ও দুইজন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে।
সোমবার (২১ অক্টোবর) সন্ধ্যা ছয়টায় মানিকনগর এলাকায় উচ্চচাপ (এইচটি ক্যাবল) বিদ্যুৎলাইনের তার পরিবর্তনের কাজ করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তি হলেন বিদ্যুৎ লাইনকর্মী (ফোরম্যান) মো. নবীর হোসেন। আহতরা হলেন, মাসুম মিয়া ও রবিউল ইসলাম। তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। 
এ ঘটনায় নিহত নবীর হোসেনের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম মুগদা থানায় সোমবার দিবাগত রাতে মামলা (মামলা নং- ১৭) দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে ডিপিডিসির মানিকনগর ডিভিশনের কমপ্লেইন সুপারভাইজার (সিএস) মো. আলী আজম খান ও মানিকনগর গ্রিডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইমরানসহ অজ্ঞাতনামা বেশ কয়েকজন। 
মামলার এজাহারে জানা যায়, বিদ্যুৎ লাইনকর্মী (ফোরম্যান) মো. নবীর হোসেন ডিপিডিসির মানিকনগর ডিভিশনের বাৎসরিক ঠিকাদার ‘মেসার্স মুন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং‘কোম্পানিতে কর্মরত ছিলো। 
জানা যায়, মানিকনগর এলাকার ডিপিডিসির ওয়াসা ফিডারে দুপুর থেকে বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে তার পরিবর্তনের কাজ চলছিলো। শ্রমিকরা কর্মরত থাকা অবস্থায় সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুতের উচ্চচাপ সঞ্চালন লাইন চালু করে দেয় মানিকনগর ডিভিশনের কমপ্লেইন সুপারভাইজার (সিএস) মো.আলী আজম খান। এতে ঘটনাস্থলেই নবীর হোসেন মারা যান। পরে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত অপর দুই সহযোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের একজনের হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। 
সোমবার গভীর রাতে ঘটনার সংবাদ পেয়ে বাংলা স্কুপের প্রতিবেদক মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন, এতবড় দুর্ঘটনার পরও ডিপিডিসির কোন কর্মকর্তাকে সেখানে যাননি।  
ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত রবিউল ইসলাম জানান, সোমবার (২১ অক্টোবর) সকাল থেকে সায়দাবাদ ফিডারে মানিকনগর ডিভিশনের বাৎসরিক ঠিকাদার মুন পাওয়ার কোম্পানির তত্ত্বাবধানে বিদ্যুৎ লাইন সংস্কারের কাজ চলছিলো। দুপুরের কিছু আগে কাজ শেষ হয়ে গেলে ঘটনাস্থলে কর্মরত বিদ্যুৎকর্মী নবীর হোসেনের মুঠোফোনে সঞ্চালন লাইন চালু করার ক্লিয়ারেন্স না নিয়েই লাইন চালু করে দেওয়া হয়। ঘটনাচক্রে ওই মুহুর্তে দুর্ঘটনার হাত থেকে বিদ্যুৎকর্মীরা প্রাণে বেঁচে যান। মানিকনগর ডিভিশনের কমপ্লেইন সুপারভাইজার (সিএস) মো. আলী আজম খান ওই সময়ও কন্ট্রোলরুমের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর এই দায়িত্বহীনতার খবর শোনার পরও মানিকনগর ডিভিশন কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। 
এর কিছুক্ষণ পর ডিপিডিসির পিডিএসডি প্রকল্পের মানিকনগর ওয়াসা রোড এলাকায় ১১ স্প্যান উচ্চচাপ সঞ্চালন লাইন পরিবর্তনের কাজ শুরু হয়। সন্ধ্যার পর পরই এই কাজ শেষ করতে গিয়েই এই দুর্ঘটনা ঘটে।
প্রশ্ন হলো, পিডিএসডি প্রকল্পের নির্দিষ্ট ঠিকাদার ছাড়া ওই ডিভিশনের বাৎসরিক ঠিকাদাররা কেন এই কাজ করবে? কাজ করতে গিয়ে কেউ নিহত ও আহত হলে, এর দায় কে নিবে? 
সূত্র জানায়, ঐ এলাকায় কাজ চলমান অবস্থায় পিডিএসডি প্রকল্পের কোন কর্মকর্তাই উপস্থিত ছিলেন না। এতবড় দুর্ঘটনা হওয়ার পরও ওই প্রকল্পের কোন কর্মকর্তাকে রাতে মুগদা মেডিকেল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা যায়নি। 
মানিকনগর ডিভিশনের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সেলিম সিরাজ মুঠোফোনে জানান, এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একইদিনে সকালে সায়দাবাদ ফিডারে রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করতে গিয়ে কন্ট্রোলরুমের দায়িত্বে থাকা কমপ্লেইন সুপারভাইজার (সিএস) মো. আলী আজম খান বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ক্লিয়ারেন্স না নিয়ে চালু করেছেন, এটা অবহিত ছিলাম না। বিষয়টি জানলে হয়তো রাতের ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটত না। তিনি আরো বলেন, ঘটনার দিন কাজ চলার সময় পিডিএসডি প্রকল্পের কোনও কর্মকর্তাই সেখানে ছিলেন না। তাই এই দুর্ঘটনার দায় আমার নয়।
মামলার মূল অভিযুক্ত মানিকনগর ডিভিশনের কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা কমপ্লেইন সুপারভাইজার (সিএস) মো. আলী আজম খান মুঠোফোনে জানান, এ দুর্ঘটনায় তার কোন দায় নেই। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, মানিকনগরের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী পুরো কাজটি তদারকি করেছেন। দুর্ঘটনা ঘটার ৪/৫ মিনিট আগে মুঠোফোনে সেলিম সিরাজ তাকে (আলী আজম) জানান, ঘটনাস্থলে কর্মরত বিদ্যুৎকর্মীদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে এবং তাকে সঞ্চালন লাইন চালু করার জন্য নির্দেশ দিলে দুর্ঘটনায় পড়ে যায় বিদ্যুৎকর্মীরা। 
এ বিষয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, সোমবার গভীর রাতেই ঘটনা তদন্তে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ তাঁকে আহ্বায়ক এক সদস্যের কমিটি (স্মারক নং- ২৭.৮৭.০০০০.০০০.১৬.০৩৩.২১.৮৯) গঠন করে। কমিটিকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি আরও জানান, ঘটনা তদন্তে মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সকালেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিদ্যুৎকর্মীদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেন, ঘটনায় যেই দায়ী হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর নিহত-আহতদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আলোচনা চলছে, দ্রুতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছেন কিউ এম শফিকুল ইসলাম। তিনি আরো বলেন, মানিকনগর ডিভিশনের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বহীনতার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছি। তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে পিডিএসডি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহেদ মাহবুব ভূঞা মুঠোফোনে জানান, এটি একটি দুর্ঘটনা। তবে ভবিষ্যতে কাজ করতে গেলে আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। অপর এক প্রশ্নে তিনি জানান, ডিপিডিসিতে এই প্রকল্পের যত কাজ হচ্ছে তা ওই ডিভিশনেরই বাৎসরিক ঠিকাদার দ্বারা করানো হয় এবং এটার শ্রমিক বিলও এই প্রকল্প থেকে দেয়া হয়। আমাদের প্রকল্পে লোকবল সংকটের কারণে মাঠপর্যায়ে কাজ তদারকি করতে বেগ পেতে হয়। 
শাহেদ মাহবুব দাবি করেন, ওই দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে তাঁর দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন এবং দুর্ঘটনার পরে হাসপাতালেও তারা গিয়েছিলেন ও চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছেন।  
এ বিষয়ে ডিপিডিসির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) মোরশেদ আলম খান মুঠোফোনে বাংলাস্কুপকে জানান, বিদ্যুতে কাজ করতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। এ বিষয়ে আমি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। রিপোর্টে যদি কাউকে দায়ী করা হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই প্রকল্পের পরিচালক দুর্ঘটনার দায় কোন অবস্থাতে এড়াতে পারেন না। তাঁকে আমি এই বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করেছি।
সূত্র জানায়, এরকম ঘটনা ডিপিডিসিতে প্রায়ই ঘটে। দুর্ঘটনার পর নিহত ও আহতরা কখনই ক্ষতিপূরণ পায় না। আর এ জাতীয় দুর্ঘটনায় গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কোন তদন্ত কমিটিই কখনই কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেয় না। আর সে কারণেই প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানির মত মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। প্রতিটি দুর্ঘটনায় পথে বসে পড়ে একটি পরিবার।
গাইবান্ধায় নবীর হোসেনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা স্বামীর হত্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানিয়েছেন।

বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ