স্থানীয়দের কাছে ছোট পদ্মা নামে পরিচিত নদীটি। এটি মূলত পদ্মার একটি শাখা নদী। একটা সময় এই নদী ছিল প্রবহমান, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা। নদী ঘিরে গড়ে উঠেছিল বসতি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই নদীপথে অবাধ যাতায়াত ছিল যাত্রীবাহী লঞ্চ, ট্রলার, নৌকা, স্টিমার এমনকি পণ্যবাহী জাহাজের। নদীটি ঘিরেই ছিল স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা। তবে এখন সেসব শুধুই স্মৃতি। একটি মাত্র বেড়িবাঁধ বদলে দিয়েছে পুরো নদী এবং নদী পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রা। যার ভুলে এক সময়ের প্রবহমান নদীটি আজ মৃতপ্রায়।
স্থানীয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার আনন্দবাজার এলাকায় প্রবহমান ছিল পদ্মা-মেঘনার একটি শাখা নদী। স্থানীয় লোকজন একে ছোট পদ্মা হিসেবেই জানে। ৩৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই শাখা নদীটি উত্তর প্রান্তের পদ্মা নদীর ছুরিরচর হয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ প্রান্তের নরসিংহপুর ফেরিঘাট হয়ে মেঘনায় মিশেছে। যাতায়াতে সহজতর হওয়ায় এই রুট দিয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল ও চাঁদপুরগামী লঞ্চ চলাচল করতো। পাশাপাশি নদীতে মালামাল নিয়ে চলাচল করতো ট্রলার, নৌকা, স্টিমার ও পণ্যবাহী জাহাজ। এতে নদীটি ঘিরে গড়ে উঠেছিল কৃষি, মৎস্য ও বাণিজ্যকেন্দ্র।
২০০৮ সালে তারাবুনিয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার সড়কপথে সংযোগ ঘটাতে সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আনন্দবাজার নদীর ওপর নির্মিত হয় সখিপুর আনন্দবাজার বেড়িবাঁধ। এই প্রকল্পের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন সেনাকর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ইসমাইল। বেড়িবাঁধ নির্মাণের এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই নদীটির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে নদীটি শুকিয়ে মরা নদীতে রূপান্তরিত হয়। এবং ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের নৌযান চলাচল।
ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবিকা বন্ধ হয়ে যায়। এতে হাজারো জেলে ও কৃষক বেকার হয়ে পড়েন। কৃষিকাজে দেখা দেয় তীব্র পানি সংকট। এছাড়াও ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। এক সময়ের ব্যস্ত লঞ্চঘাট এখন নীরব। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল ও চাঁদপুরগামী লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষকে বিকল্প পথে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। যা একদিকে সময় ও অপরদিকে অর্থের অপচয়। নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর উভয় পাড়ের সরকারি খাস জমি দখলে নিতে শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল।
স্থানীয়দের দাবি, আনন্দবাজার বেড়িবাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি ছোট সেতু তৈরি হলে নদীতে আবার পানি প্রবাহ সচল সম্ভব। এতে কৃষকরা সারা বছর চাষাবাদের জন্য পানি পাবে, জেলেরা নদীতে মাছ ধরার সুযোগ পাবে এবং নৌযান চলাচল শুরু হলে বাণিজ্যিকভাবে পণ্য পরিবহনে সহজতর হয়ে বেকার মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে।
স্থানীয় মাদরাসার শিক্ষক ইদ্রিস আলী মিয়া নামের এক ব্যক্তি বলেন, এক সময়ের প্রবহমান নদীটি শুধু মাত্র অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দেওয়ার কারণে মরে গেছে। এটির ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। কেননা এই নদীটির সঙ্গে মানুষ এবং জীববৈচিত্র্যের গভীর সম্পর্ক ছিল। নদীভাঙনকে পুঁজি করে নদীর ওপর যেই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অবৈধ। প্রশাসনের কাছে দাবি, বেড়িবাঁধের স্থানে একটি ছোট সেতু স্থাপন করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হোক।স্থানীয় জেলে শহিদুল খাঁ বলেন, এক সময় আমাদের এই নদীতে অনেক মাছ পাওয়া যেতো। আমাদের পূর্বপুরুষরা এই নদীতে মাছ ধরে সংসার চালিয়েছে। তবে এখন এই নদী শুকিয়ে যাওয়ায় আগের মতো মাছ নেই। আমাদের ভীষণ কষ্ট হয়। আমরা চাই বেড়িবাঁধ থাকুক, তবে বেড়িবাঁধের একটা অংশে কালভার্ট বসিয়ে পানির প্রবাহ সচল করা হোক।
নুরা মাস্টারের বাজার এলাকার বাসিন্দা সিদ্দিক ফকির বলেন, আমাদের অঞ্চলে এই নদীর পানি দিয়ে কৃষিকাজ করা হতো। তবে আনন্দবাজার বেড়িবাঁধের কারণে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে দিনদিন জমিগুলো অনাবাদি ও চাষের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে কৃষিকাজ সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আমরা আর ফসল উৎপাদন করতে পারবো না।শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তারেক হাসান বলেন, প্রায় ১৬ বছর আগে নদীভাঙন রোধে আনন্দবাজার বেড়িবাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে এটির কারণে ধীরে ধীরে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে স্থানীয়দের সমস্যা হচ্ছে। আমরা জনগণের সমস্যার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি। পদ্মা-মেঘনার শাখা নদীটির পানি প্রবাহ পুনরুদ্ধারে আলোচনা চলছে।
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন