প্রয়োজন না থাকলেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। বছরের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে অলস বসে ছিল এসব কেন্দ্র। উচ্চমূল্যের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা পকেটে পুরেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা।
বিদ্যুৎ খাতে গত ১৫ বছরের লুটপাট নিয়ে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত স্বৈরাচার সরকারের তিন মেয়াদে ১৫৮টিরও বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুকূলে পরিশোধিত লাখো কোটি টাকার বিলসহ যাবতীয় নথি হাতে নিয়েছে দুদক।
মঙ্গলবার (৬ মে) বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যানের কাছে এসব নথি চেয়ে চিঠি দেন দুদকের অনুসন্ধান দলের দলনেতা ও উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন। সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ঘুষ গ্রহণ, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রকল্প পাস করানো, সরকারি জমি দখল ও ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে এসব নথি তলব করা হয়। কমিশনের চিঠিতে বিপিডিবির সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্পাদিত চুক্তি, পাওয়ার পারচেস এগ্রিমেন্ট, ইম্পিলিমেন্টেশন এগ্রিমেন্টসহ সব চুক্তির নথি চাওয়া হয়। এ ছাড়া চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনুকূলে পরিশোধ করার যাবতীয় বিল ও বকেয়া বিল সংক্রান্ত নথিসহ অন্যান্য যাবতীয় নথি চাওয়া হয়।
এ বিষয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম সোমবার (১২ মে) বাংলা স্কুপকে বলেন, দুদকের চিঠি পাওয়ার পর চাহিদামত নথিপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। আজকেও দুদক কিছু নথি চেয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে সব ধরনের সহযোগিতা আমরা করছি। তদন্তাধীন বিষয়ে এর বেশি বলা সমীচীন নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দুদক সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে চলেছে হরিলুট। বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইন বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ করে আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যবসায়ীদের উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সরকারের তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার। টাকার হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকা। শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামেই আত্মসাৎ হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ক্রয় এবং ভূমি অধিগ্রহণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে ভয়াবহ অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সক্ষমতায় ব্যবহার করা হবে—এমন শর্তে লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু এসব কেন্দ্র চলেছে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। উচ্চমূল্যের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লুটে নেয়া হয় বিপুল অংকের অর্থ।
জানা যায়, ২০০৯ সাল আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরপত্রের মাধ্যমে ৮টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়। বিনা দরপত্রে ৩২টি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণ করে। দরপত্র এড়াতে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে দুই বছরের জন্য পাস করা হয় জরুরি বিশেষ আইন। পরে আইনটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়। এই আইনের অধীনে ৭২টি রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়। বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় অংশই পেয়েছেন তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং সাবেক আমলারা।
তথ্যমতে, বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র পাওয়া গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম ইউনাইটেড গ্রুপ। তাদের ৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। এগুলো হচ্ছে আশুগঞ্জ ৫৩ মেগাওয়াট কুইক রেন্টাল, আশুগঞ্জ ১৯৫ মেগাওয়াট মডুলার,ময়মনসিংহ ২০০ মেগাওয়াট, আনোয়ারা চট্টগ্রাম ৩০০ মেগাওয়াট ও পটুয়াখালী ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলোর নথিপত্র এখন দুদকে।
অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ইউনাইটেড গ্রুপ লুটে নিয়েছে ৭ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতে এই লুটপাটের অঙ্ক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের তোষামোদ করে সীমাহীন লুটপাট চালিয়েছে গ্রুপটি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে শহিদ মইনুল হক সড়কে অবস্থিত তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয় এবং বাড়িটি ভেঙেও ফেলা হয়। বাড়িটি ভেঙে ফেলার নেপথ্যে ছিলেন ইউনাইটেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের এক নিকটাত্মীয়। এই ব্যক্তি ওই সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে ছিলেন। তারই লাগাতার তোষামোদির প্রতিদান হিসাবে আওয়ামী লীগ সরকার ইউনাইটেড গ্রুপকে সীমাহীন অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিতে থাকে। সাড়ে ১৫ বছরে ফুলে-ফেঁপে ওঠে গ্রুপটি। বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাত থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে তারা। এই হরিলুটে সরাসরি সহযোগিতা করেছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। এই বিপুকেও আবার ঘুষ হিসাবে নামমাত্র মূল্যে দেওয়া হয়েছে রাজধানীর ১০০ ফুট সড়কের পাশে অবস্থিত ৮০ কাঠা জমি, যার বর্তমান মূল্য দেড়শ কোটি টাকার বেশি।
আরও ভয়ংকর তথ্য হলো, শেখ হাসিনা ও তাঁর দুই সহযোগী প্রভাবশালীর আনুকূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার নামে পাওয়ার প্ল্যান্ট বানিয়ে সেই বিদ্যুতের বড় অংশ চড়া দামে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে বিক্রি করে সাধারণ গ্রাহকের পকেট কাটা হয়েছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইউনাইটেড গ্রুপের কর্মকর্তা শামীম মিয়া। তিনি বাংলা স্কুপকে বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আমরা কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নিইনি। বরং দরপত্রে আমরা অনেক কম টাকা দেখিয়ে কাজ পেয়েছি। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে টাকা লুট করা হয়েছে এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি সঠিক নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকলে সর্বনিম্ন যে টাকাটা আসে, সেটুকুই আমরা পেয়েছি। শামীম মিয়া আরো বলেন, আমাদের এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিপুল অবদান রাখছে ইউনাইটেড গ্রুপ। আমরা ঋণখেলাপি নই।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণেই বিষয়গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া হচ্ছে, এমন সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
নথি বলছে, বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র পেয়েছে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার এবং এনার্জিপ্যাকও। সামিট গ্রুপের সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। কনফিডেন্স গ্রুপ বিনা দরপত্রে পেয়েছে ৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। তারা পেয়েছে ৯৬২ কোটি টাকা। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে রয়েছে বাংলাক্যাটের ৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। তালিকায় রয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সেম্বকর্পের নাম। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এপিআর এনার্জি পেয়েছে ৬৮০ কোটি টাকা।
ডরিন গ্রুপ বিনা দরপত্রে পেয়েছে ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ডরিন পাওয়ারের মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে ও ঝিনাইদহ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী তাহজীব আলম সিদ্দিকী।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রতিষ্ঠান দেশ এনার্জির চার বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া পায় ৫১৫ কোটি টাকা।
(বিদ্যুৎ খাতের লুটপাট নিয়ে বাংলা স্কুপের ধারাবাহিক প্রতিবেদন আসছে)
বাংলাস্কুপ/প্রতিবেদক/এসকে
বিদ্যুতে বিপুর সীমাহীন দুর্নীতি, অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক